ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বরিশালের ৩৬ গ্রামে পেয়ারার রাজ্য

প্রকাশিত: ০৭:৩৩ এএম, ২৭ জুলাই ২০১৫

বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার ভর মৌসুম শুরু। ঝালকাঠি-বরিশাল-পিরোজপুর জেলার ৩৬টি গ্রাম জুড়ে প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর গড়ে উঠেছে পেয়ারার রাজ্য। তাই দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকা জুড়ে পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাইকার এবং পেয়ারা চাষিদের বেচা কেনার ধুম চলছে পেয়ারার মোকামগুলোতে।  এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরী বলা হয়।  তবে জাতীয় ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত।  আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে।  তাই পেয়ারাকে ভালোবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’  হিসেবে গণ্য করে।  

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক এই আড়াই মাস জমে উঠে পেয়ারা বেচা-কেনা।  পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট বড় ব্যবসা কেন্দ্র।  এ মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আটঘর,  কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি।  প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে।  তা কিনে ট্রলারযোগে নৌপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।



এবছর ফাল্গুনে পেয়ারা গাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খড়ায় পানির অভাব দেখা দেয়ায় ফুল ঝড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা যায়।  অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারাচাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেনি।  কিন্তু তারপরেও এবার পেয়ারার ভালো ফলন  হয়েছে।  কেটে গেছে চাষিদের দুশ্চিন্তা।  

ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারাচাষি জাহিদ মিয়া বলেন, খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিল।  কিন্তু, আমাদের ভাগ্য ভালো ফলন ভালো হয়েছে।   এইবার মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।  কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে।  প্রতি মণ ১শ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।  প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে বিভিন্নস্থান থেকে নৌপথে পেয়ারা বাগানে আসে পর্যটকরা।  পেয়ারা বাগানে এসে দেখে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনেও নিচ্ছেন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য।

বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়ক পথে যোগাযোগের যথোপযোগী ব্যবস্থা না থাকা।

এ ব্যাপারে ঝালকাঠির জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষি বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়।  কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল।  তাই দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।  পাশাপাশি পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা সড়ক পথে নেয়ার কোনো সঠিক ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি।  

পেয়ারা চাষিরা জানিয়েছে, এ অঞ্চলের সাথে সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা সম্ভব।  উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে পেয়ারাচাষিদের বাগান থেকে সরাসরি ট্রাক যোগে প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পেয়ারা পৌঁছে দেয়া এবং পচনরোধ করা সম্ভব হত।

আড়তদার লিটন হালদার বলেন, ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম।  মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মণ পেয়ারা বিক্রি হয়।  তবে বাউকাঠি থেকে ভিমরুলী হয়ে কীর্তিপাশা পর্যন্ত সড়ক পথ হলে দ্রুত প্রতি দিনের পেয়ারা প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো সম্ভব হতো।  ভিমরুলী মোকাম থেকে নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালি, ভোলা, মাদারিপুর, নাটোর ও বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে।  কিন্তু, সড়ক পথের যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনতো।

ব্যাংক ছাড়াই কোটি টাকার লেনদেন : সভ্যতার ধারাবাহিক ঐতিহ্য কত বছর টিকে থাকে? সময়ের পরিবর্তনে সভ্যতার দৈর্ঘ্য একেক রকমের।  একটি বাজার ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।  তাও আবার নদীর মধ্যে গড়ে ওঠা ভাসমান বাজার।  আশ্চার্য্য হওয়ার বিষয় যে, এখানে নেই কোনো চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ছিনতাইকারি, পকেটমার এবং নেই কোনো আইন-শৃঙ্খলার নিরাপত্তার চাদর।

তারপরও এখানে আসা দারুন নিরাপত্তার মধ্যেই বছরের পর বছর তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।  লাখ লাখ টাকা নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই তারা রাত কাটাচ্ছেন। কিন্তু, কেউ একটি টাকাও হারিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই।  এলাকার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন শত শত বছরের।  ঝালকাঠির সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের একটি গ্রাম ভীমরুলী।  তিনটি ছোট ছোট নামবিহীন খাল মিলেছে একত্রে।  যার উৎসস্থল সুগন্ধা আর সন্ধ্যা নদী।  এই খাল তিনটির মোহনাতেই গড়ে উঠেছে ভাসমান বাজার।

বাজারের নির্মল বেপারী জানান, এ এলাকায় কোনো চোর, ডাকাত সন্ত্রাসী পকেটমার নেই।  ব্যবসায়ীরা তাই নিরাপদে ব্যবসা করতে পারেন।  প্রতিদিন ফজরের আগেই খালে এসে জড়ো হয় শত শত নৌকা।  সকাল ৮টা থেকে কেনা বেচা শুরু হয়ে চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত।  আর পেয়ারার মৌসুমে বেচাকেনা চলে সারাদিন।

প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ টাকার বেশি বেচা কেনা হয় এই বাজারে।  কিন্তু কাউকে খাজনা বা আড়তদারী দিতে হয় না।  এখানে মানুষের বন্ধনটা খুবই দৃঢ়।  আর এ কারণেই কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারছেন।  এলাকার মানুষেরা পাহারা দিয়ে রাখে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, মাসে ১৫/১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয় এই পানির ওপর।  যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে তাদের ব্যবসা আরো ভালো হতো।  স্থানীয় এবং বাহির থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জানান, ভীমরুলীর এই ভাসমান বাজারই হতে পারে দৃষ্টান্ত।  পুরো দেশ ভীমরুলী বাজারের মতো চাঁদাবাজমুক্ত হতে পারে যদি মানুষে মানুষের সদ্ভাব এবং বন্ধনটা ভালো হয়।  

এক মণ পেয়ারায় ৩ কেজি চাল মেলে না : আমরা পেয়ারা বেচি ২-আড়াই টাকা কেজি।  সেই পেয়ারা ঢাকায় কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়।  এক মণ পেয়ারা বেচে ৩ কেজি চালও মেলে না।  কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারাচাষি অজিত দুয়ারি।



জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় পেয়ারা পুষ্টিমান সমৃদ্ধ বলে একে বাংলার আপেল বলা হয়।  ঝালকাঠির চাষিরা এ পেয়ারা প্রায় শত বছর ধরে চাষ করে আসছে।  হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বিস্তৃত এ বাগানে প্রতিবছর পেয়ারা উৎপাদিত হয়।  অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানকার পেয়ারা বাজারজাত করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ।  তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীমরুলীর খালে বসে পেয়ারার ভাসমান হাট। ছোট ছোট নৌকায় করে চাষিরা বাগান থেকে ভাসমান হাটে নিয়ে আসে পেয়ারা।  

পেয়ারা চাষি ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, প্রাণ কোম্পানি জেলি তৈরির জন্য এ বছর চাষিদের কাছ থেকে কিছু পেয়ারা কিনতে শুরু করেছে।  প্রতিবছর বড় বড় কোম্পানি যদি জেলি তৈরির জন্য এখান থেকে পেয়ারা কিনতো, তাহলে আমরা বেশি লাভবান হতাম।  আর সবচেয়ে ভালো হতো ভীমরুলী গ্রামে জেলি কারখানা স্থাপন করলে।  

ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় বিদেশেও পাড়ি : ফরমালিনের ঝাঁজে বাজারের ফলে হাত দেয়ার জো নেই।  যত ফল বাজারে মেলে এর কোনটিতে ফরমালিন নেই, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।  তবে বাজারের একমাত্র ফল বাংলার আপেল খ্যাত বরিশালের পেয়ারা, যাতে ফরমালিন মেশানো হয় না!

বাকলবিহীন ফল পেয়ারায় পুষ্টি ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ : বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারায় পুষ্টি ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ রয়েছে।  একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমপরিমাণের ভিটামিন থাকে।  এছাড়াও একটি কমলা লেবুর চেয়ে চারগুণ বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে।  প্রতিটি পেয়ারায় রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল।  ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ২০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে, যা কমলার চেয়ে চারগুণ বেশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।  পেয়ারার খোসায় কমলার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে।  এ ফলে লৌহ উপাদানও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।  পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল আছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধক।  ১০০ গ্রাম পেয়ারায় পানি ৮৬.১০ গ্রাম, শক্তি ৫১ কিলো ক্যালোরি, প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম, আঁশ ৫.৪ গ্রাম, ফসফরাস ২৫ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ৭৯২ আইইউ থাকে।  এ ছাড়া পেয়ারাতে ম্যাঙ্গানিজ, সেলিনিয়াম, ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩ ইত্যাদি মূল্যবান খনিজ ও ভিটামিন থাকে।  রোগ প্রতিরোধে পেয়ারার রয়েছে বহুগুণ।  পেয়ারার বীজে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ পলিআন-সেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ও আঁশ বিদ্যমান।  পেয়ারা পাতার রস ক্যান্সার প্রতিরোধী এবং সংক্রমণ, প্রদাহ, ব্যথা জ্বর, বহুমূত্র, আমাশয় ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এমএএস/পিআর