উত্তরাঞ্চলে বাসের ছাদে মানুষের হাট
শুক্রবার বিকেল ৫টা। গাইবান্ধা থেকে ঢাকাগামী একটি বাস এসে দাঁড়ালো বগুড়ার বনানী বাইপাস মোড়ে। ৫২ আসনের গাড়িটিতে যাত্রী তোলা হয়েছে দেড়শতাধিক। ভেতরে টুল, বেঞ্চ ছাড়াও ছাদের যাত্রীদের মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কারণ অসাবধানতা বশত কেউ যেন চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে না যায়।
এই বাসেরই যাত্রী মিনহাজুল নামের এক যুবক ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। জানালেন ভাড়া দিছি ৬শ ট্যাকা, তারপরেও ভেতরে সিট হয়নি। রোববার কামে যোগ দেওয়া লাগবি। তাই ছাদত বসিচি। একুন আল্লাহ ভালো ভালো লিয়া গেলে হয়।
ঈদও শেষ এর ছুটিও শেষ তবে আমেজটা এখনো রয়ে গেছে। আর ঘরে ফেরা মানুষগুলো প্রতিদিনই ফিরছে কর্মস্থলে, ফিরছে রাজধানীতে। ঈদের ছুটি শেষ হলেও এখনো লোকে লোকারণ্য হয়ে চিরচেনা রূপ পায়নি ঢাকা। ঢাকার রূপ ফেরাতে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন বাহনে ঝুলতে ঝুলতে ফিরছে নানা যন্ত্রণায় ভরা যান্ত্রিক শহরে। ঈদের শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই বাড়ির টানে গ্রামের পানে যেভাবে ছুটেছে মানুষ ঈদ শেষ হওয়ার পরও সেই একই দৃশ্য চলমান। আনন্দ উৎসব করে ফিরতে এই মানুষগুলো ঝুঁকি নিলেও আইন থাকা সত্ত্বেও কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। আর তাই যেখানে সেখানেই এখন দেখা যাচ্ছে চলন্ত গাড়িতে ঝুলন্ত মানুষ। চলাচলের অযোগ্য লক্কর-ঝক্কর গাড়ির সংখ্যাও রয়েছে অনেক।
অতিরিক্ত যাত্রী ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম রোধে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), পুলিশ, পৌরসভা, বাস মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হলেও তাদের নাকের ডগায় অনিয়ম চলছে বগুড়া জেলার বাস টার্মিনাল ও সড়ক মোড়গুলোতে। চোখের সামনে দিয়েই বাসের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো হচ্ছে এবং পিকআপে যাত্রী বহন ও টাউন সার্ভিসের বাসগুলো ছেড়ে যাচ্ছে দূর পাল্লার রুটে। শুধু তা-ই নয়, যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এত অনিয়ম হলেও ভ্রক্ষেপ নেই ভিজিলেন্স টিমের। একে অপরের ওপর দোষ চাপানোতেই তারা ব্যস্ত।
বিআরটিএ বগুড়ার সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান জানান, সড়কে তাদের টিম কাজ করছে।
তবে এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করার কথা মোটর মালিক শ্রমিকদের। আর বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল লতিফ মন্ডল জানান, এসব দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। আমরা শুধু অরাজকতা যাতে না হয় সেই দিক দেখছি। আর হাইওয়ে পশ্চিমাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল হক জানান, এই মূহুর্তে বাধ্য হয়েই অনেক কিছু ছাড় দিতে হচ্ছে। আসলে মানুষ ছুটছে অন্য রকম একটা গতিতে। এ কারণে কিছুই করার থাকছে না।
শনিবার সকালে বগুড়ার চারমাথা ও ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ডে সরেজমিনে দেখা যায়, যেসব গাড়ি অন্য জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচল করতো তারা খোলস পাল্টে দূরপাল্লার গাড়িতে পরিণত হয়েছে। সুযোগ বুঝে সাধারণ যাত্রীদের পটেক কাটছে। আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া। উপায়ন্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে যাত্রীরাও বাড়তি টাকা দিচ্ছেন। অন্য সময় বগুড়া ঢাকা রুটে ভাড়া ৩৫০ টাকা হলেও এখন বাসের ছাদেই ভাড়া নিচ্ছে ৫শ টাকা। আর ভেতরের মূল্য (সিট ছাড়াও) আরো অনেক বেশি।
মহাখালিগামী যাত্রী জাহিদুর রহমান বলেন, ভাড়া যেখানে সাড়ে ৩শ টাকা সেখানে এখন দালালরা ভাড়া চাচ্ছেন ৭শ থেকে ৮শ। কী করবো, কর্মস্থলেতো যেতেই হবে। বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যাচ্ছি। এ চিত্র শুধু ঢাকা রুটে নয়, দেশের বিভিন্ন রুটেও বাস মালিক ও দালালরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন।
এদিকে বাসের ছাদে চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও ছাদের উঠতে দেখা গেছে অনেক যাত্রীকে। বিআরটিএ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনেই চলছে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়া হচ্ছে তাদের। যাতে করে ছিটকে সড়কের উপরে পড়ে না যায়। হন্তদন্ত হয়ে বাসের ছাদে উঠছেন বগুড়ার মেয়ে রাণী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের ছাদে উঠছেন কেন ? তিনি বলেন, ‘কী করবো ? বাসের ভেতরে তো সিট নেই। সিটের অপেক্ষায় থাকতে গেলে রাত হয়ে যাবে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে যাচ্ছি। কপালে যা আছে তাই হবে। ছাদে যাওয়ার জন্য তাদের প্রতিজন ৪৫০ টাকা গুণতে হয়েছে।’
পাশের একটি বাসের ছাদ উঠছিলেন রিকশাচালক সাইফুল। কোথায় যাবেন ? জিজ্ঞেস করতেই অনেকটা বিরক্ত হলেন তিনি, যেন তার কথা বলার সময়টুকু নেয়। তিনি সাভার চৌরাস্তা যাবেন বলেন জানালেন।
শুধু রাণী ও সাইফুল নয়, এদের মতো শত শত যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলের দিকে ফিরছেন। ছাদে যাত্রী নেয়া এক বাসের চালকের সঙ্গে কথা হয়। বাসের ছাদে যাত্রী উঠানো নিষিদ্ধ তাহলে ছাদে যাত্রী উঠাচ্ছেন কেন ? তিনি বলেন, ‘কী করার আছে। যাত্রীদের আর ফেলে রাখা যায় না। সবাইকে তো ফিরতে হবে। আর এখন যেহেতু প্রশাসন একটু সুযোগ দিচ্ছে সে কারণে আমরাও ঝুঁকি নিচ্ছি।
বাস মালিক আব্দুল বাসেদ বলেন, আমাদের বাসগুলো আগে পাবনা রুটে চলাচল করতো। কিন্তু ঈদের যাত্রী বহনের জন্য অনেক বাস রাজধানী বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসনের ভিজিলেন্স টিমের তথ্য কেন্দ্রে গেলে সেখানে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে টিম গঠন করা হলেও তারা জানে না ওই মুহূর্তে কারা কারা দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে সমন্বয় দেখা যায়নি।
তথ্য কেন্দ্র অবস্থানরত একজন মোটরযান পরিদর্শকের কাছে সমন্বয় কমিটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানান। যদিও তিনি ভিজিলেন্স টিমের একজন সদস্য।
বগুড়া তিনমাথা মোড়ে দাড়িয়ে থাকার যাত্রী কাদের মুন্সি বলেন, বাসের ছাদেতো রীতিমতো মানুষের হাট বসেছে। কিছুদিন আগে দুর্ঘটনা বেড়ে যাবার কারণে বাসের ছাদে যাত্রী যাতায়াত প্রায় বন্ধই ছিল। তবে এবার ঈদ থেকে বন্ধ থাকা সেই বিষয়টি যেন আবার চালু হয়ে গেল। আর যাত্রীদের বেড়ে গেছে মৃত্যুর ঝুঁকিও। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো বাসের ছাদে যাতায়াত করে থাকে অল্প ভাড়ার জন্য। কিছু টাকা বাঁচিয়ে পরিবার সংসারে বাড়তি যোগান দেয়ার জন্য। আর বাসের চালক ও হেলপাররা এই যাত্রীগুলো নিয়ে থাকে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। তবে একশ্রেণির মানুষের স্বল্প খরচ আর এক শ্রেণির মানুষের বাড়তি আয়ের কারণে কতগুলো পরিবার যে হুমকির মুখোমুখি প্রতিমুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকে সে খবর কেউ রাখে না। বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও থানার পুলিশ বিষয়টি দেখলেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি কোনোস্থানেই।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা বাসস্ট্যান্ডও দেখা গেছে একই রকমের চিত্র। কর্মস্থলে ফিরতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লেগে আছে মানুষের ভিড়। স্থানীয়রা জানান, শিবগঞ্জ, কালাই, সোনাতলা, গাবতলী ও সাঘাটা উপজেলার প্রায় এক লাখ শ্রমিক ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। অনেকেই রিকশা চালান বা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। এরাই কেউ বাসের ছাদে আবার কেউ ট্রাকে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন।
এমএএস/পিআর