হিমঘরে আতিয়া মহলের তদন্ত
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় ‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গিবিরোধী সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ এর একবছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের এদিন ওই এলাকার শান্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতি আচমকা বদলে যায়।মুহুর্মুহু গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে সিলেট নগর। সবকিছু মিলে টানা পাঁচদিন আতঙ্কের মধ্যে ছিল নগরবাসীর জীবনযাপন।
আতিয়া মহলে সেনাবাহিনী কমান্ডোদের সেই ‘অপারেশন টোয়াইলাইটে’ চার জঙ্গি নিহত ও অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়েরকৃত পৃথক দুটি মামলার তদন্তের আজও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
সেসময় জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছিল। মামলার তদন্তভার প্রথমে পুলিশের হাতে থাকলেও পরে তা হস্তান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। কিন্তু এরপর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এখনও পর্যন্ত আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে মাত্র একজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি তিনজনের পরিচয়ই নিশ্চিত করতে পারেনি পিবিআই।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, দুটি মামলা দায়েরের পর পুলিশ কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামত সংগ্রহ করেছিল। সিআইডিও কাজ করছিল। পরে তদন্তভার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সিলেটে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, গত বছরের মে মাসে মামলা দুটি আমরা পাই। এখনও তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মর্জিনা নামের এক নারী জঙ্গির পরিচয় শনাক্ত করা হয়। অপর তিন জঙ্গির নাম পরিচয় ও তাদের সঙ্গে আর কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, আতিয়া মহলে প্রাপ্ত বিস্ফোরকের রাসায়নিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে এগুলো শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলে। পাঁচ ও চারতলা দুটি ভবন নিয়ে আতিয়া মহল। পাঁচতলা ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা। অভিযান চলাকালে আতিয়া মহলের দুইশ ফুট দূরে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের পাশে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখার প্রধান, পুলিশের দুই পরিদর্শক ও এক ছাত্রলীগ নেতাসহ সাতজন নিহত হন। আহত হন আরও অর্ধশতাধিক।
আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী। তিনি সিলেট আমদানি-রফতানি অফিসে ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান। বছর পাঁচ আগে নিজের স্ত্রীর নামে আতিয়া মহল নির্মাণ করেন তিনি।
ফিরে দেখা সেই দুর্ধর্ষ অভিযান :
২৪ মার্চ ২০১৭ : জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই চলতি বছরের ২৪ মার্চ আতিয়া মহল ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটসহ সবগুলো ফ্লাটের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা রুদ্ধশ্বাস জঙ্গিবিরোধী অভিযান।
২৫ মার্চ ২০১৭ : সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর শতাধিক প্যারা কমান্ডো ট্যাংকসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আতিয়া মহলে আসেন। ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেনের নেতৃত্বে কমান্ডোদের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু হয় সকাল সোয়া ৯টায়।
সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিযানের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সেনা সদর দফতরের গোয়েন্দা পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তার ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতিয়া মহলের প্রায় দুইশ’ গজ দূরে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন চারজন। হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান আরও দুজন। গুরুতর আহত হওয়া র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদও পরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বিস্ফোরণে আহত হন সাংবাদিকসহ আরও অর্ধশতাধিক মানুষ।
২৬ মার্চ ২০১৭: সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় বিস্ফোরণ আর গুলির টানা শব্দ। বিকেলে সেনা সদর দফতরের গোয়েন্দা পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান জানান, আতিয়া মহলে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। ভেতরে আরও একাধিক জীবিত জঙ্গি থাকতে পারে। জঙ্গিরা ভবনের ভেতর বিস্ফোরক ছড়িয়ে রাখায় অভিযানে সময় লাগছে।
২৭ মার্চ ২০১৭: সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ফের শুরু হয় গোলাগুলি। এদিন কয়েকবার আতিয়া মহল থেকে গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। দুপুর নাগাদ ভবন থেকে ধোয়াও উড়তে দেখা যায়। সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে ফখরুল আহসান জানান, চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন পুরুষ, একজন নারী। ভেতরে আর জীবিত জঙ্গি নেই।
২৮ মার্চ ২০১৭: আতিয়া মহলে দিনব্যাপী অভিযানের পর পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। নিহত চার জঙ্গির দুজনের মরদেহও পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এফএ/এমএস