মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ভরাট করা হচ্ছে শতবর্ষী পুকুর
নগরীর চকবাজার কেবি আমান আলী রোডের বড়মিয়া মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ভরাট করা হচ্ছে শতবর্ষী পুকুর। আর এই কাজ করছেন মসজিদ পরিচালনা পরিষদের নামে পুকুরে মালিকানা আছে এমন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
চকবাজার বড় মিয়া মসজিদ লাগোয়া বলে প্রায় ১০০ গজ আয়তনের মসজিদটি বড়মিয়া মসজিদ পুকুর হিসেবেই পরিচিত। মসজিদের মুসল্লিরা অজু ও গোসল করেন এই পুকুরে। এছাড়া স্থানীয়দের অনেকেই গোসলসহ নানা কাজে এই পুকুর ব্যবহার করে থাকেন। মসজিদ সম্প্রসারণের নামে ইতোমধ্যে পুকুরের ৩০ ভাগ বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এ কাজে জড়িতরা মসজিদ সম্প্রসারণের অজুহাত দেখালেও স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেছেন এই জায়গা শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হবে।
সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকাশ্যেই ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। পুকুরে শ্রমিকদের মাটি ফেলার দৃশ্য দেখলে মনে হয় না কোনো লুকোচুরি আছে। সাধারণ মানুষ দেখছেন প্রতিনিয়ত ভরাটের এই দৃশ্য। কিন্তু চোখে পড়ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের কারও। এ প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রাই। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী বড়মিয়া মসজিদ পুকুরের অর্ধেকটা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। মসজিদের উন্নয়নের জন্য এ পুকুর ভরাটের কথা বলা হলেও বাস্তবে এটি মসজিদের নামে মার্কেট গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার অংশ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, পুকুরটি ভরাট করায় মুছে যাবে অনেক স্মৃতিচিহ্ন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ অনেকে পুকুরটির অংশীদারি মালিক। যেহেতু পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ তাই মসজিদের নামে পুকুরটি ভরাট করে পরবর্তীতে তা প্লট আকারে বিক্রি বা মার্কেট তৈরি করা হবে। অংশীদারি মালিকানার পুকুর হওয়ায় প্রায় অর্ধশত মালিক রয়েছে এই পুকুরের। ১৯৯১ সালের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। ২০০৬-০৭ সালের চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় মাত্র চার হাজার ৫২৩টি জলাশয়। বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে তার সঠিক তথ্য কারও কাছেই নেই। তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১৫ হাজার জলাধার ভরাট কিংবা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
নগর পরকিল্পনাবদিরা বলছেন, এ বিষয়ে সচতেনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। এ কাজটি সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করা যেতে পারে। ৬০ লাখ জনসাধারণের নগরীতে কী পরিমাণ পুকুর-জলাশয় দরকার তা যথাযথ জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করা জরুরি।
কৌশলে ভরাট করা হচ্ছে বড় মিয়া মসজিদ পুকুর
চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের বড়মিয়া মসজিদ শত বছরের পুরনো একটি মসজিদ। সেই মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে অংশীদারি মালিকানার প্রায় ১০০ গজ আয়তনের পুকুর যা বড় মিয়া মসজিদ পুকুর হিসেবেই পরিচিত। বছরখানেক ধরে পুকুরের পূর্ব পাশে ময়লা আবর্জনা ফেলে ভরাট শুরু হয়। আবর্জনা ফেলে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর রাতে ট্রাক ভর্তি বালু ফেলে পুকুরটির উত্তর-পূর্ব পাড়ে ভরাটের কাজ চলছে। বলা হচ্ছে, বড় মিয়া মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য চলছে এই ভরাট কাজ। স্থানীয় বাসিন্দা জামসেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ছোট বেলা থেকে এই পুকুরে গোসল করি। গত কয়েক বছরে পুকুরের চারদিক থেকেই বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা ফেলে পুকুরের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এটি পুকুর না কোনো বিল তা আলাদা করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম জলাশয়-জলাধার রক্ষা কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট রেহেনা বেগম রানু জাগো নিউজকে বলেন, নগরীর বেশির ভাগ পুকুর-জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর-জলাশয় ভরাটের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ছে। গত দুই-তিন দশকে নগরীতে কী পরিমাণ পুকুর জলাশয় বিলীন হয়েছে তা শীঘ্রই অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। মহানগরীতে জনগণের বহুমুখী নিরাপত্তার জন্য কী পরিমাণ জলাশয় থাকা দরকার তা নিশ্চিত করে জানানোর দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি কর্পোরেশনের। তিনি বলেন, মানুষের জীবনধারণে পুকুরের প্রয়োজনীয়তা অপার। খেলার মাঠ যেমন প্রয়োজন তেমনই পুকুরেরও প্রয়োজন রয়েছে। জলাধার হচ্ছে লক্ষ জীবনের আধার। শিশুরা এখানে সাঁতার কেটে জীবন শুরু করবে। অগ্নিকাণ্ডে মানুষ পুকুরের সাহায্য নেবে। তিনি আরও বলেন ‘জলাধারে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন র্কতৃপক্ষ অনুমতি দেবে না।প্রয়োজনে মসজিদটি বহুতল করা হোক। কিন্তু কোনোভাবেই পুকুর ভরাট করা যাবে না। পুকুরের জীবন নেয়ার অধিকার কারও নেই। সেই জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা ভরাট করেছে তাদেরকেই দিতে হবে। যতটুকু ভরাট হয়েছে তাও ভরাটকারীদের নিজের খরচে তা উদ্ধার করে দিতে হবে। অন্যথায় আইনের সাহায্য নিতে আমরা বাধ্য হব।’
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, যারা নগরীতে পুকুর-জলাশয় ভরাট করছে তারা এর ক্ষতিকর দিকটি জেনে শুনেই করছে। এর সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত। যাদেরই মালিকানাধীন হোক না কেন পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া পুকুর ভরাট করা যাবে না। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি এখনই ফোর্স পাঠাচ্ছি।
এদিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে মসজিদ কমিটির কাউকে পাওয়া যায়নি। আশপাশের কেউ এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়। পরে মসজিদের ইমামের কাছ থেকে মুঠোফোন নাম্বার নিয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি মারুফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সিডিএ’র ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে দশমিক ৫ একরের নিচের পুকুর ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিডিএ’র অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে এর কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি জানিয়েছেন সিডিএ’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান।
ওআর/পিআর