মরদেহের অপেক্ষায় স্বজনরা
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সুদে টাকা ধার নিয়ে মাত্র দুই বছর আগে স্ত্রী-সন্তান রেখে সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন জসিম। স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা আর স্বজনদের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু সব কিছুই যেনো ফিকে হয়ে গেছে। দিন বদলের স্বপ্নে দিন কাটছিল স্বজনদের। এখন তাদের বুক ভাসছে কান্নায়।
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কিশোরগঞ্জের জসিম উদ্দিনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে জসিমের পরিবার। একদিকে স্বজন হারানোর কষ্ট অপরদিকে সুদের টাকা পরিশোধ আর পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাদের। প্রিয়জনের লাশের অপেক্ষায় স্বজন আর এলাকাবাসী।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার জিনারি ইউনিয়নের চরহাজীপুর গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো. জসিম উদ্দিন (৪৪)। গত শনিবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টার দিকে সৌদি আরবের জিজান প্রদেশে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় জসিমসহ নয়জন নিহত হন।
মঙ্গলবার বিকেলে হোসেনপুরে নিভৃতপল্লী চরহাজীপুর গ্রামে জসিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলে হারানোর শোকে বিছানায় গড়িয়ে মাতম করছেন জসিমের বৃদ্ধ মা রাবেয়া খাতুন। ঘরের অন্য কোণে মাটিয়ে লুটিয়ে কাঁদছে জসিমের স্ত্রী মিনার আক্তার। তাকে জড়িয়ে রোদন করছে মেয়ে রুনা আক্তার (১৪) এবং দুই জমজ ছেলে রনি এবং জনি (১০)।
জসিমের মেয়ে স্থানীয় চরহাজীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। আর জমজ দুই ছেলে আরিফুল ইসলাম রনি চর হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে এবং শরিফুল ইসলাম রনি একই স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ছে।
ঘটনার পরদিন জসিমের মৃত্যুর খবর আসে পরিবারের কাছে। খবর পেয়ে সেখানে যান জসিমের শ্বশুর মো. নিজাম উদ্দিন। মেয়ে আর নাতিদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তিনি নিজেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না।
পাঁচ ভাই ও এক বোনের সংসারে জসিম ছিলেন তৃতীয়। দিন মজুরি করে সংসার চলছিল না। তাই এলাকার কয়েক জনের কাছ থেকে সুদে ৯ লাখ টাকা নিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবে যান জসিম। কাজ নেন জিজান প্রদেশে আল ফাহাদ নামে এক কোম্পানিতে। মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে নিজের খরচ চালিয়ে সামান্য টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। এ দিয়েই কোনোভাবে খেয়ে-না খেয়ে চলতো তার পরিবার। কিন্তু জসিমের মৃত্যুর পরই চরম অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
নিহত জসিমের ভাই আবু বকর সিদ্দিক জানান, চড়া সুদে টাকা নিয়ে তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল । দুই বছরে মাত্র ৩ লাখ টাকার মতো তিনি বাড়িতে পাঠান। এ দিয়ে সংসারের খাবার আর তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচই চলতো না। এখন সুদের টাকা কিভাবে পরিশোধ হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় গোটা পরিবার।
জসিমের স্ত্রী মিনার আক্তার জানান, জসিম বিদেশ যাওয়ার পর থেকেই সন্তানদের জন্য ব্যাকুল ছিল। মাঝে মাঝে বাড়িতে ফোন করে তাদের খোঁজ-খবর নিত। সর্বশেষ ঘটনার আগের দিন শুক্রবার রাতে আমার কাছে ভিডিও কল দেয়। সন্তানদের সঙ্গেও কথা বলে।
আমাকে তিনি বলেছিলেন, চিন্তা করো না। খুব শিগগিরই বাড়িতে টাকা পাঠাবো। বেতন বাড়লে সুদের টাকাও পরিশোধ হবে। আমাদের অভাব দূর হবে। সুখের দিন আসবে। কিন্তু এখন আমি কোথায় যাব? কার কাছে আশ্রয় নেব?
নিহত জসিমের মরদেহ কবে দেশে আসবে তা বলতে পারছে না পরিবার। এ জন্য তারা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মরদেহ ফেরত আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করব।
নূর মোহাম্মদ/আরএআর/আইআই