একজন মন্ত্রীর পুরনো দুই টিনের ঘর
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন অ্যাড. ছায়েদুল হক। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগের এ বর্ষীয়ান নেতা। তিনি ছিলেন সততার মূর্ত প্রতীক। অর্থ-প্রাচুর্য কোনো কিছুতেই মন ছিল না তার। সবসময় সাধারণ মানুষ আর এলাকার উন্নয়ন নিয়েই ছিল সব ভাবনা।
ছায়েদুল হকের জীবনযাত্রা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তিনি সবসময় বলতেন ‘দুনিয়ার চাকচিক্ক থাকবে না, একদিন সবকিছুর হিসাব দিতে হবে।’ তাইতো পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও কোনো সম্পদ গড়তে পারেননি তিনি।
তার নিজ গ্রাম নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বাভাগ গ্রামের উত্তরপাড়ায় রয়েছে দুটি টিনের ঘর। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এ দুটি টিনের ঘরই তার সম্বল ছিল। দীর্ঘদিনের পুরোনো দুই ঘরের একটিতে থাকতেন মন্ত্রী আর অন্যটি ছিল তার বৈঠকখানা। গ্রামের সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসে কথা বলতেন বৈঠকখানায়। যদিও মন্ত্রীর ওই ঘরটি স্থানীয়দের কাছে ডাক বাংলো হিসেবেই বেশি পরিচিত।
শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুরে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরনো দুটি টিনের ঘরে শুধুমাত্র দুটি খাট ও কাঠের কিছু ফার্নিচার এবং কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার পড়ে আছে। বাড়িতে এলে ওই টিনের ঘরে পুরনো খাটেই ছায়েদুল হক ঘুমাতেন বলে জানিয়েছেন তার নিকট আত্মীয়রা। কোনো কিছুর প্রতি লোভ ছিল না তার।
ছায়েদুল হকের চাচাতো ভাই আবদুল বাছির জাগো নিউজকে বলেন, অর্থ-বিত্ত নিয়ে তার কোনো ভাবনা ছিল না। আমাদের শুধু বলতেন একদিন সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। তিনি কখনো অন্যায় কাজ করেননি। মন্ত্রী হয়েও সবসময় সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করেছেন। গ্রামের মানুষদের তিনি বলতেন আমি এমপি-মন্ত্রী না, আমি তোমাদের ছায়েদুল হক।
ছায়েদুল হকের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বানেশ্বর দেবনাথ বলেন, ৫১ বছর ধরে আমি ছায়েদুল হককে চিনি। আজ পর্যন্ত আমি তার কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। তার মতো লোক এই জীবনে আর দেখব কি না জানি না।
ছায়েদুল হকের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফি উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, নাসিরনগরে ছায়েদুল হকের বিকল্প আর কোনো নেতা নেই। তার মতো এমন সৎ নেতার মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রী ছায়েদুল হক ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেন মাটি ও মানুষের এই নেতা।
হাওর বেষ্টিত নাসিরনগর উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে জড়িয়ে আছে ছায়েদুল হকের নাম। জেলা সদরের সঙ্গে নাসিরনগরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক মাইলফলক। এখনো তার কয়েকশ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছায়েদুল হক গতকাল শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আজ রোববার বাদ জোহর নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বাভাগ গ্রামের পশ্চিমপাড়াস্থ কল্লরপাড় পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়েরর কবরের মাঝখানে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ছায়েদুল হক।
উল্লেখ্য, ছায়েদুল হক ১৯৪২ সালে নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বভাগ গ্রামের উত্তপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের খ্যাতনামা এ আইনজীবী ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি বিজয়ী হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন।
এফএ/এমএস