‘দেশে ফিরে দুইদিন আমরা না খেয়ে ছিলাম’
আলমগীর মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানী। ১৯৭১ সালে টগবগে যুবক আলমগীর মিয়া অস্ত্র হাতে ৩নং সেক্টরের অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল ও আশুগঞ্জে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন রক্তমাখা স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা। আলমগীর মিয়া তার তিন বন্ধু মিলে যুদ্ধে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে।
১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের আলমগীর মিয়ার বয়স ছিল ১৮ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে গায়ের রক্ত টগবগ করতে থাকে তার। তবে বাড়ি থেকে তখনও তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। ওই বছরের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল গিয়েছিলেন আলমগীর মিয়া। ফেরার পথে একটি বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার সময় রাজাকারদের সহায়তায় পাঁচজন ছাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। এই দৃশ্য নিজ চোখে দেখে সহ্য করতে পারেননি আলমগীর। বাড়ি ফিরে তিন বন্ধুকে নিয়ে যুক্তি করেন যুদ্ধে যাওয়ার।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর মিয়া বলেন, বাবা-ভাইয়েরা যদি যেতে না দেন সেজন্য তাদেরকে না জানিয়ে শুধুমাত্র বড় বোনকে বলে তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ১৭ আগস্ট যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রওনা হই আমি ও আমার তিন বন্ধু। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় পাড়ি জমাই আমরা। আমাদের সঙ্গে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সীমান্তের ওপারে আমাদের নেয়ার জন্য ছদ্মবেশে মিত্র বাহিনীর লোক অপেক্ষা করছিল।
১৭ আগস্ট রাতে আমরা ত্রিপুরা বাজারে পৌঁছাই। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আমাদের পাঠানো হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। দুই জায়গায় প্রায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য দেশে ফিরি আমরা।
ফেরার সময় সীমান্তে আমাদের সতর্ক করে বলা হয়েছিল কেউ যেন হাঁচি-কাশি না দেন। হাঁচি-কাশি এলে যেন মুখে গামছা ঢুকিয়ে দেই। কেননা শব্দ করলেই পাক বাহিনী টের পেয়ে হামলা করতে পারে। অবশেষে দেশে ফিরে সীমান্তবর্তী এলাকার একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেই আমরা। কমান্ডারসহ মোট ৬১ জন মুক্তিযোদ্ধা গুহায় অবস্থান নেই। দেশে ফেরার দুইদিন পর্যন্ত আমরা না খেয়েছিলাম। পরে একটি বাড়ি থেকে আমাদেরকে তরকারি ছাড়া শুধুমাত্র ভাত দেয়া হয়েছিল। আমরা সবাই মিলে সেই ভাত খেয়েছিলাম। তবে গুহায় আমাদের অবস্থানের বিষয়টি রাজাকারের মাধ্যমে পাক বাহিনী জেনে যাওয়া পরদিন ভোরে গুহা ছেড়ে সরাইলের দিকে রওনা হই।
৬ জন করে মোট ১০ ভাগে ভাগ করা হয় আমাদের। আমরা মনস্থির করি প্রথমে সরাইল থানায় গড়া পাক হানাদারদের ক্যাম্পে হামলা চালাবো। তবে সেই অপারেশনে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। আমরা হামলা চালানোর পর অন্য ক্যাম্প থেকে আবার পাক সৈন্য সরাইল থানা ক্যাম্পে চলে আসে। ওই অপারেশনে একজন রাজাকার মারা গিয়েছিল। এছাড়া আমাদের তিনজন সহযোদ্ধা আহত হয়েছিল।
আলমগীর মিয়া বলেন, ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার আগের দিন ১৩ জন পাক সৈন্য আশুগঞ্জ যাওয়ার পথে সরাইলে আমরা তাদেরকে আটক করি। পরে আমরা তাদের চোখ বেঁধে জয় বাংলা স্লোগান দিতে বলি। তখন পাক সৈন্যরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছিল। ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে বিনাযুদ্ধে সরাইলও মুক্ত হয়।
আলমগীর মিয়া আরও বলেন, ৯ ডিসেম্বর আশুগঞ্জের সোহাগপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে পাক সৈন্যদের সঙ্গে মিত্র বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক নীরিহ গ্রামবাসী মারা যান। এরপর পাক সৈন্যরা আশুগঞ্জের সাইলোতে গিয়ে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ওয়াপদা সড়কে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে।
১০ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে পাক সৈন্যরা ভৈরবের দিকে পালাতে থাকে। যাবার আগে তারা আশুগঞ্জ রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে দিয়ে যায়। এরপর ১১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আশুগঞ্জকে শত্রমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
আজিজুল সঞ্চয়/এমএএস/আরআইপি