ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

মাঠজুড়ে আমন ধান, বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক | খুলনা | প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ০১ ডিসেম্বর ২০১৭

‘গগণে সাদা মেঘ দেখি না তো আর, শরৎ ঋতু ধীরে ধীরে লয়েছে বিদায়। মাঠে মাঠে ধরে আছে সোনার ধান, আনন্দেতে ধান কাটে চাষিরা সবাই। নবান্ন উৎসব আজ সবার ঘরে ঘরে, উল্লাসেতে মেতে ওঠে বাঙালির প্রাণ’- লক্ষণ ভান্ডারীর কবিতার এ পঙক্তিগুলো হেমন্তের বাংলার চিনচেনা রূপ।

যদিও গ্রাম-বাংলায় ‘নবান্নের’উৎসব শুরু হয় মূলত অগ্রহায়ণ মাসের শুরু থেকে। তবে এখন আগাম জাতের ধানের কারণে হেমন্ত ঋতু শুরুর আগে থেকেই নবান্নের ঘ্রাণ বাতাসে।

খুলনার দাকোপ উপজেলায় দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয় তিনটি দ্বীপ। বিধ্বস্ত দ্বীপে হয়েছে ধান। যে দিকে তাকানো হয় সে দিকেই দেখা যায়, ধানের শীষ। ছড়াচ্ছে হেমন্তে আমন ফসলের গন্ধ। কৃষকদের মুখে স্বপ্ন বিভোর সোনালি হাসি। নতুন করে আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার আমন ফলন গত কয়েক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন কৃষকরা। এরই মধ্যে অনেক জমির ধান আধাপাকা অবস্থায় দোল খাচ্ছে। আবার কিছু জমির ধানের শীষ বের হচ্ছে।

সরেজমিন উপজেলার তিনটি পোল্ডার ঘুরে দেখা যায়, চালনা পৌরসভা, পানখালী, তিলডাঙ্গা, কামারখোলা, সুতারখালী, বাজুয়া, কৈলাশগঞ্জ, দাকোপ, লাউডোব, ও বানিশান্তা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মাঠ আমন ধানের চাষবাদে ভরে গেছে।

দাকোপের কালিকাবাটি গ্রামের কৃষক চিত্তরঞ্জন মণ্ডল জানান, ২০০৭ সালে ১০ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছিলাম। ধান গাছের অবস্থা ছিল খুবই ভালো। স্বপ্ন ছিল সোনালি ফসল ঘরে তোলার। এমন স্বপ্ন বিভোর সময়ে উপকূলে দানবীয় শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর। সিডরে ধানগাছের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এর ওপর পোকার আক্রমণও চরমভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অন্য বছর যেখানে বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ১৮ মণ করে ধান পেতাম। সেবার পেলাম ১০ বিঘায় মাত্র ৫৫ মণ। সারা বছর কীভাবে কাটাতে হবে সে চিন্তা করে তখন বসে থাকতাম। তখন এলাকার কমবেশি সবাই মিলে বোরো আবাদ করি। ধান খুব বেশি না পেলেও খোরাক নিয়ে আর চিন্তা ছিল না।

পশ্চিম বাজুয়া গ্রামের কৃষক ফনি ভুষণ মণ্ডল বলেন, বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাসে ৩৫ বিঘা জমিতে আউশ চাষ করেছিলাম। প্রথমে ধান গাছের অবস্থা ছিল ভালো। কিছু দিন পরে লবণাক্ততার কারণে ধানগাছ মারা যায়। পেলাম মাত্র ৭৬ মণ আউশ ধান। যা গত বছর ২২ বিঘা জমিতে ১৪ থেকে ১৫ মণ পেতাম বিঘা প্রতি। কিছুটা চিন্তায় ভেঙে পড়েছিলাম। এরপর আমন চাষ করলাম। ফলন এখন পর্যন্ত খুবই ভালো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ক্ষতির পরিমাণ পোষাতে পারব।

কামারখোলা গ্রামের কৃষক বিনয় কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ২০০৯ সালে আইলায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চল। জোয়ারের পানি ওঠা-নামা করে ২০১০ সাল পর্যন্ত। এ সময় জমিতে আর সোনার ফসলের শীষের দোল দেখতে পেতাম না। পেশায় ছিলাম কৃষি কাজে নিয়োজিত। তাই পারলাম না আর বসে থাকতে। স্বপ্ন দেখলাম সোনালি ফসল ফলানোর। নিজের ছিল ৫ বিঘা, আর বর্গা নেয় ৫ বিঘা। পানি ওঠা-নামার মধ্যে মোটা জাতের ধান চাষ করলাম। ধান গাছের অবস্থা ছিল খুবই ভালো। এক সময় পানির সঙ্গে উঠতে থাকে পলি মাটি। পলি মাটি জমে যাওয়ায় ধান গাছের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। চিন্তায় পেয়ে বসে কি করে কাটাব সারাটি বছর। এর মধ্যে হয়ে গেল রাস্তার বাঁধ। এলাকার সবাই মিলে করলাম আমন চাষ। ফলনও খুবই ভালো হয়। গেলবার বিঘা প্রতি ২২ থেকে ২৪ মণ পেয়েছি। এবারও ফলন অনেকটাই ভালো।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাকোপের অধিকাংশ কৃষিজমি একসময় ছিল এক ফসলি। ৮০ দশকে কিছু জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে তরমুজের চাষ করা হলেও পরিমাণে তা ছিল খুবই কম। কিন্তু সিডরে এলাকার কৃষকরা বড় ধাক্কা খান। এরপর তারা কৃষিতে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়েন। আয় বাড়াতে এলাকায় তরমুজ চাষ বাড়াতে থাকে। বাড়াতে থাকে সবজির চাষ। এরপর আবার আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কৃষি খাত। তবে মারাত্মক দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে এ অঞ্চলে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে বোরো, দেড় হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ, ২০ হেক্টর জমিতে আউশ, ৫ হেক্টর জমিতে পাট ও ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ১০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ কমে যায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন জানান, এ অঞ্চলের উৎপাদিত সবজি জেলার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। টানা দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হলে কৃষি কাজে ব্যাপক ক্ষতি হয় জেনেছি। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের কোনো কৌশল জানা ছিল না। হতাশ হয়ে পড়েছিলও বটে।

তিনি আরও জানান, গত দুই বছর থেকে বিধ্বস্ত দ্বীপে মানসম্মত, পুষ্টিকর সবজিসহ সব ফসল ফলাতে সক্ষম হয়েছি। আর খুলনা থেকে নলিয়ান অভিমুখে বিশ্বরোড নির্মাণ, বেসরকারি কোম্পানি নির্মাণে আমন চাষ জমির পরিমাণ কমেছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে গতবারের তুলনায় এবার ফসল অনেকটা ভালো হবে।

আলমগীর হান্নান/এএম/পিআর