‘বাতাস ছোডলেই কইলজা কাইপ্পা ওডে’
‘হোমকে (সামনে) গাঙ, পিছে খাল, উত্তরে-দক্ষিণে ধারে কাছে কোনোহানে একটা বিল্ডিং নাই। বাতাস ছোডলেই কইলজা কাইপ্পা ওডে। বইন্যা আইলে কুম্মে যাইয়া এট্টু আশ্রয় লমু, পরানডারে বাঁচামু’।
সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আশ্রাফ আলী আকন ভয়াল সিডরের স্মৃতিচারণ করে এ সব কথা বলেন। বয়সের ভারে ন্যুজ এই বৃদ্ধের চোখে-মুখে এখনও শঙ্কার ছাপ। পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
বিষখালীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত দক্ষিণ কুপদোন গ্রাম। গ্রামটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। অদূরেই পাড় ভেঙে ক্রমেই লোকলয়ে প্রবেশ করছে খরস্রোতা বিষখালী নদী। পেছনে খাল, উত্তর ও দক্ষিণে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের দেখা মেলে না। ২০০৭ সালের ভয়াল সিডরে এই গ্রামেরই পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছিল। এদের প্রত্যেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বানের জলে ভেসে ডুবে মারা যায়।
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য মতে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের (সাইক্লোন শেল্টার) সংখ্যা মোট ৩৫১টি। জেলার ১২ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র দেড়লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে এসব কেন্দ্রে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের অপর্যাপ্ততার ফলে সংকেত এলেই শঙ্কিত হয়ে পড়েন নারী ও শিশুসহ স্থানীয় অধিবাসীরা। সিডরে সবচেয়ে বেশি প্রাণ ও সম্পদহানি হয় নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্ত ১০ বছর পার হলেও এখনও এসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি।
দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের বাসিন্দা রুস্তম আলীর স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, ‘কয়দিন আগে ‘মোরা’ বইন্যার সংকেত দেছে। ডরের চোডে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ অইয়া গেছিল, গুরাগারা (ছেলে-মেয়ে) লইয়া কুম্মে যাইয়া উইট্টা পরানডা বাঁচামু’।
একইভাবে বিষখালী বলেশ্বর ও পায়রার তীর ঘেঁষে বসবাসরত বরগুনার বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগে অনিরাপদ হয়ে পড়েন। দূরবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে ছুটাছুটি করতে গিয়ে প্রাণহানি ঘটে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের।
উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ ঝুঁকি নিরসনে কাজ করা বরগুনার বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন এনএসএস’র নির্বাহী পরিচালক সাহাবুদ্দিন পান্না বলেন, দুর্যোগপ্রবণ বরগুনা জেলার অপেক্ষাকৃত নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের দুর্যোগকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সিডরের ১০ বছর পরেও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এখনও বড় কোনো দুর্যোগের সংকেত এলে এখানকার বাসিন্দারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এসব বিষয় ভাবনায় রেখে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামসমূহ বাছাই করে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকন মো. শহীদ বলেন, খরস্রোতা বিষখালী নদী তীরবর্তী কালমেঘা ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস নদী তীরে। ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য এ ইউনিয়নে মাত্র ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। দুর্যোগের সময় এসব মানুষদের আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে হয়। নদী তীরের বাসিন্দাদের অন্তত প্রতি এক কিলোমিটার ব্যবধানে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে এসব মানুষদের দুর্যোগের সময় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব।
উপকূলীয় উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারী’র প্রধান নিবার্হী হোসনে আরা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরে আমরা দেখেছি উপকূলের মানুষ কতটা অনিরাপদ। এরপর ১০ বছর কেটেছে কিন্তু উপকূলের বাসিন্দাদের দুর্যোগকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) বরগুনা সদর উপজেলার সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, বরগুনার মোট জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ এখনো দুর্যোগ ঝূঁকিতে রয়েছে। সিডরের পর অপরিকল্পিতভাবে কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে। প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনরা তাদের ইচ্ছেমত স্থানে সেসব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। অথচ যে সব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্রের চরম সংকট সেখানে তা নির্মিত হয়নি। ফলে এখনো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষগুলোর অধিকাংশই ঝড়ের সময় অনিরাপদেই থাকেন।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, ধাপে ধাপে বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের কাজ চলছে। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী তীরবর্তী ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাচ্ছি।
সাইফুল ইসলাম মিরাজ/আরএআর/আরআইপি