সুন্দরগঞ্জে কর্মসৃজন প্রকল্পে কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কর্মসৃজন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দে ১ কোটি ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবরা যোগসাজশে হতদরিদ্র শ্রমিকের নামে গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে ও চেকে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ সকল টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার (ইউএনও, বর্তমানে ঠাঁকুরগাঁও সদরে সহকারী কমিশনার ভূমি হিসেবে কর্মরত) মো. রাশেদুল হক প্রধান ও সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (বর্তমানে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় কর্মরত) মো. জহিরুল ইসলাম এ অর্থ লুটপাটে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় দহবন্দ, হরিপুর ও বেলকা ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক মেম্বার স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দফতরে গত ১৭, ২০ ও ২৫ মে পৃথক লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত দল সরেজমিন অভিযোগের তদন্ত করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে (৪০ দিন) সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের জন্য ৪ হাজার ৪৭৪ জন হতদরিদ্র শ্রমিক কাজ করবেন। শ্রমিকের মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ ২০০ টাকা। ৪০ দিনে এ সকল শ্রমিকের জন্য ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় ইউএনও রাশেদুল হক প্রধান ও পিআইও জহিরুল ইসলাম দহবন্দ, হরিপুর ও বেলকা ইউনিয়নে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও সচিবের সঙ্গে আঁতাত করে ৪৭৬ জন হতদরিদ্র শ্রমিকের নাম গোপন রেখে বরাদ্দের টাকা ১৫ ইউনিয়নে বিভাজন করে তালিকা প্রণয়ন করেন। গোপন করা সুবিধাভোগী শ্রমিকদের মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নে ১৬৭ জন, দহবন্দ ইউনিয়নে ১১৮ জন ও হরিপুর ইউনিয়নে ১৯১ জন রয়েছে।
পরে ৪৭৬ জন শ্রমিকের ভুয়া নামের তালিকা, ভুয়া কাগজপত্র ও ব্যাংক অ্রাকাউন্ট দেখিয়ে চেকে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০০ টাকা হারে ৪০ দিনে ৩৮ লাখ ৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, কর্মসৃজন প্রকল্পে ১৫ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নামে ব্যাংকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট নম্বর দেখিয়ে প্রতি ইউনিয়নে ৫০ জন শ্রমিকের নাম গোপন করা হয়। এতে ১৫ ইউনিয়নের ৭৫০ শ্রমিকের বিপরীতে ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
এছাড়া ১৫ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের আনুষঙ্গিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা, ১৫ ইউনিয়ন পরিষদের ১৩৫ জন সদস্যদের (মেম্বার) আনুষঙ্গিক ২ হাজার টাকা হিসেবে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও সুবিধাভোগী শ্রমিকদের সার্ভিস ভাতা ২ হাজার টাকা হারে ১৩৫ জনের ২ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ মোট ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকার বিল পাস করা হয়। পরে ওই টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেনের নামে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড সুন্দরগঞ্জ শাখার মাদার অ্যাকাউন্ট থেকে ৪টি চেকে উত্তোলন করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট ইউএনও, প্রকল্প কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান ও সচিবরা পর পর যোগসাজশে বিল-ভাউচার পাস করে মোট ১ কোটি ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করে ভাগ-বাটোয়ারা করেন।
দহবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান মণ্ডল বলেন, তার ইউনিয়নের ১১৮ জনের নাম গোপন করে টাকা উত্তোলনের বিষয় জানা নেই। তৎকালীন ইউএনও ও পিআইও এসব ভাল বলতে পারবেন।
হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোজাহারুল ইসলাম ও বেলকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক সরদার বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পে অর্থ লুটপাটের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউএনও মো. রাশেদুল হক প্রধান জানান, কর্মসৃজন প্রকল্পে অভিযোগের বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এ বিষয়ে তৎকালীন পিআইওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তবে সরকারি অর্থ লুটপাটে সহযোগিতা ও ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
এদিকে, অভিযুক্ত পিআইও মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ হয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নেব।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের সুন্দরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক আবদুস সাত্তার বলেন, ৪টি মাদার অ্যাকাউন্টের কাগজপত্র অনুযায়ী জমা দেওয়া চেক যাচাই করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বর্তমান প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. নূরুন্নবী সরকার বলেন, উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রকল্প অফিসের অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেনকে অফিসিয়াল দায়িত্ব থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে রাখা হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বর্তমান নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবদুল হাই মিল্টন বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় তার সময়ে নয়। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন-১) মো. একরামুল হকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সামাদ বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অভিযোগের কিছু বিষয় প্রমাণ হওয়ায় আত্নসাৎ করা টাকার মধ্যে ২২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন হলে সরকারি অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অমিত দাশ/এসএস/এমএস