ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

মেঘের দিন আইলেই ডর লাগে

প্রকাশিত: ০৪:৫৩ এএম, ২৭ জুন ২০১৫

নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-অগ্রণী সেচ প্রকল্প-১ ও সেচ প্রকল্প-২ এর ভেতরে জলের সঙ্গে বসবাস করছেন প্রায় ৫ লাখ মানুষ। সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-অগ্রণী সেচ প্রকল্পের ভেতরের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। কোনো কোনো এলাকায় হাঁটু পানি জমেছে, আবার কোথাও জমেছে কোমর পানি পর্যন্ত। এতে প্রকল্পের ভেতর বসবাসকারী কয়েক লাখ মানুষ এখন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

অথচ প্রকল্পের সবগুলো খাল, উপ-খাল ঠিকঠাক থাকলে এ দুর্ভোগ হওয়ার কথা নয়। এ বর্ষায় এই প্রকল্পের বাঁধের ২৭টি স্থানে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। যার ফলে পানি মূল খালে যেতে না পেরে জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে।

বর্ষার শুরুতেই এ জলাবদ্ধতা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন প্রকল্পের আওতাধীন রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ৫ লাখ বাসিন্দা। এদিকে পাম্প হাউজের পাম্পগুলো কারণ ছাড়াই চালু না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পানিবন্দী মানুষ।

সেচ প্রকল্প-১ এর ভেতরে বসবাসকারী তারাব পৌরসভা এলাকার আবু হামজা হতাশা আর ক্ষোভের সুরে জাগো নিউজকে বলেন, জীবনে বুঝি আর শান্তি পামু না। মেঘের দিন আইলেই ডর লাগে। ঘরবাড়ি পানিতে তলাইয়া যায়। আর বান (বাঁধ) ছুটলেতো জীবন শেষ। হুনছি বানের কয়েকখান ফাইডা গেছে গা। পানি আইলে আমরা কই যামু?

উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকার আমজাদ হোসেন (৬৫) বলেন, জনপ্রতিনিধি আসেন, জনপ্রতিনিধি যায়। সবাই ভোটের আগে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচিত হলে কেউ আর আমাদের কথা মনে রাখেন না। সবাই নিজ স্বার্থে মিথ্যা বুলি আওড়ায়।

মোগরাকুল এলাকার দেলোয়ার মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ইস্কুলে যাইতে পারে না পোলাপান। পানি ভাইঙ্গা ইস্কুলে যায়। ওগো লইয়া হগল সময় ডরে থাহি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-অগ্রণী সেচ প্রকল্প-১ ও ১৯৯৩ সালে ১০১ কোটি টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-অগ্রণী সেচ প্রকল্প-২ নামে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ের পাঁচ হাজার হেক্টর জমি ঘিরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর বাদেই এখানে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। আর জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে দুর্ভোগও। জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে জানা যায়, নিয়ম-নীতি ছাড়াই প্রকল্প বাঁধের ভেতরে অসংখ্য শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব শিল্পকারখানার অনেক খাল দখল করে নেয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এছাড়া বরপা এলাকার বেশ কয়েকটি ইটভাটা সেচ প্রকল্প-২ এর খাল দখল করে ভরাট করে নেয়ায় বাঁধের ভেতরের পানির পাম্প হাউজ পর্যন্ত টেনে নেয়া সম্ভব হয় না, ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নব্বইয়ের দশকের পর নিয়ম   বহির্ভূতভাবে প্রকল্পের ভেতরে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে। একে একে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে প্রকল্পের খালগুলো। জনবসতি আর কারখানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর বাড়তে থাকে জলাবদ্ধতাও। শিল্পমালিকসহ এক শ্রেণির লোক নিজ স্বার্থে খালগুলো ভরাট করে এর যথেচ্ছা ব্যবহার করায় এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

সরেজমিনে প্রকল্পের ভেতরে শান্তিনগর, সাউদনগর, বংশীনগর, মোগরাকুল ও কাকিনা এলাকায় কোথাও কোথাও হাঁটু থেকে কোমর পানি দেখা গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ করে বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকা পানিতে ডুবে গেলেও মুড়াপাড়া বানিয়াদীর পাম্প হাউসের পাম্পগুলো পানি নিষ্কাশনের জন্য নিয়মিত চালু করা হয় না।

একই অভিযোগ এনএন আই সেচ প্রকল্পের যাত্রামুড়া পাম্পা হাউজের বিরুদ্ধেও। বড় বড় ড্রেনের মুখ খুলে দিলেও সংস্কার না হওয়া বাঁধের ক্যানেলগুলোর মুখে আবর্জনা জমে বন্ধ থাকায় পানি যেতে পারে না। বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও ত্রুটিপূর্ণ ক্যানেল নির্মাণের কারণে পানি নিষ্কাশন করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, বাঁধের রেগুলেটরগুলোর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসছে না। বেশ কিছু এলাকায় প্রকল্পের খালের পাড় কেটে নেওয়া হয়েছে। পঁচা পানি ভেতরে ঢুকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এলাকার লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় জামদানি শিল্পীদেরও মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের জানিয়েও ভুক্তভোগীরা কোনো সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-অগ্রণী সেচ প্রকল্পের উপ প্রকৌশলী রাম প্রসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে পাম্প চালু রাখা যাচ্ছে না ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পল্লী বিদ্যুতের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাহজাহান কির জাগো নিউজকে বলেন, তারাব পৌর এলাকায় লোডশেডিং নেই বললেই চলে। কখনো কখনো ঝড় বৃষ্টির কারণে ২/১ ঘণ্টা বিদুৎ থাকেনা।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, এই এলাকায় প্রায় লোডশেডিং নাই। প্রকল্পের পাম্পগুলো বিদ্যুৎ থাকাকালীন সময়ও সার্বক্ষণিক চালু থাকে না এ অভিযোগ এলাকাবাসীর। এ ব্যাপারে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এলাকাবাসী বলেন, পাম্প হাউজে কর্মকর্তা কর্মচারীরা থাকে না বললেই চলে। সেচ প্রকল্পের উপ-প্রকৌশলী আরো বলেন, ক্যানেল ও সাব ক্যানেল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন করা যাচ্ছে না।

জলাবদ্ধতার ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএও) লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময়ই তৎপর রয়েছেন। প্রকল্প এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ ও ক্যানেলগুলো ভরাট হওয়ায় পানি নিষ্কাশন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। ক্যানেলগুলো সংস্কার করা জরুরি বলেও জানান তিনি।

রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ শাহজাহান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের খাল দখল করে প্রভাবশালীরা বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন। অনেক স্থানে শিল্প-কারখানাও গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ না করলে জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতীক) জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

মীর আব্দুল আলীম/এমজেড/এমএস