১১ মাতব্বরের পেটে জলাবন লক্ষ্মীবাউড়
হবিগঞ্জের জলাবন লক্ষ্মীবাউড় হজম করে নিয়েছে ১১ জন গ্রাম্য মাতব্বর। ৫ যুগেরও অধিক সময় ধরে কৌশলে তারা ভোগ করছে বৃহৎ এ বনাঞ্চলটি। যা থেকে বছরে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩ কোটি টাকা আয় হয়। শুধু মাছ বিক্রি করেই বছরে আসে দেড় থেকে ২ কোটি টাকা। আর জ্বালানী কাঠ এবং হাওড়ে মাছ সংরক্ষণের জন্য গাছ (স্থানীয় ভাষায় কাঠা) বিক্রির প্রকৃত হিসেব নেই কারও কাছে।
তবে ধারণা করা হচ্ছে তা থেকেও আয় হয় অন্তত ১৫/২০ লাখ টাকা। ধান চাষ করেও আয় হয় প্রায় ৫০/৬০ লাখ টাকা। শীত মৌসুমে ধরা হয় অতিথি পাখিও। এগুলো দিয়ে ভোজন বিলাসের কথা স্বীকারও করেছেন এক মাতব্বর।
পঞ্চায়েতের পক্ষে নিজেদের নামে রেকর্ড করিয়ে নেয়া চতুর এসব মাতব্বর গ্রামবাসীর মুখ বন্ধ রাখতে জলাবনের আয় থেকে তাদেরও ভাগ দেয়। আয়ের একটি মোটা অংশ তারা সমিতি করে ফান্ডে জমা রাখে।
স্থানীয়দের মতে, এটি তাদের নিরাপত্তা ফান্ড। কখনও যদি সরকার বা কোনো প্রভাবশালী এনিয়ে মামলা মোকদ্দমাসহ দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়াতে চায় তাহলে এ ফান্ড থেকে তার ব্যয় বহন করা হবে। নানা কারণে ভূমি জটিলতা সৃষ্টি হলে সরকারের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমার ব্যয়ও এখান থেকেই বহন করা হয়। বনটি রক্ষাসহ স্থানীয় উপকারভোগীদের এর অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবনা দিয়েছে উপজেলা ভূমি অফিস। ইতোমধ্যে কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বানিয়াচং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ছাব্বির আহমেদ আকুঞ্জি জানান, এটি একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থান। কিন্তু ৩৬৬ একর আয়তনের এ বনভূমিটি আরএস জরিপে বিভিন্ন খতিয়ানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। এ বনটিকে সংরক্ষিত জলাবন এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ বনের আয়-ব্যয় সম্পর্কে জানতে বৃহৎ অংশীদার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে কোনো কথা বলতে অপারগতা জানান। পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি মুখ খোলেন। জানান, এটি তাদের ৭ মহল্লার সম্পদ। এটির নাম আবু ইউসুফ খান ওয়াকফ স্টেট। তাদের মুরুব্বীরা আজমিরীগঞ্জের এক জমিদারের কাছ থেকে এ জঙ্গলটির জমিদারি কিনেছিলেন। আবু ইউসুফ খান ওয়াকফ স্টেট গঠন করে এটি ওয়াকফ স্টেটের নামে করা হয়।
আবু ইউসুফ খান ছিলেন আইনজীবী ও খুব জ্ঞানী লোক। তিনি জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর ৭ মহল্লার মানুষের নামে রেকর্ড করিয়ে দেন। এরপর থেকেই তারা ভোগ দখল করছে। মাছ, গাছের ডালপালা ও ধান বিক্রি করে বছরে ৫০/৬০ লাখ টাকা আয় হয়। চলতি বছর মাছ আহরণের জন্য বিল বিক্রি হয়েছে ৫০ লাখ টাকায়। তিনিসহ কয়েকজন মিলে এটি নিয়েছেন। এখানে পাহারাদার আছে ২৫/৩০ জন। প্রত্যেককে ৮/১০ হাজার টাকা করে বেতন দিতে হয়। মাছ আহরণ করতে এখানে আরও প্রায় ৪০/৫০ লাখ টাকা খরচ হয়।
তিনি বলেন, এখানে কয়েক হাজার গাছ আছে। প্রতি বছর এখান থেকে ৫/৭শ গাছ বিক্রি করা হয়। যা থেকে ৭/৮ লাখ বা ১০ লাখ টাকা আয় হয়।
পাখি শিকারের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতি বছরই পাখি মারা হয়। আমরা আর কয়েক দিন পরে মারব। কার্তিক মাসের শেষের দিকে প্রচুর পাখি আসে। তখনই আমরা পাখি মারব। এখানে বালি, লেঞ্জা, পেরিসহ বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি পাখি। এগুলো আমরা খাওয়ার জন্য মারি। দূর-দূরান্তের বিভিন্ন স্থান থেকে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনরা আসেন পাখি শিকার করতে।
আয়ের টাকা বণ্টনের বিষয়ে তিনি জানান, লাভের টাকা ৭টি মহল্লার প্রত্যেক পরিবারকে ৫শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন ছান্দ সর্দার (সভাপতি), ৭টি মহল্লার ৪ জন সর্দার এবং একজন ক্যাশিয়ার রয়েছেন। এছাড়া আয়ের টাকা থেকে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজের উন্নয়ন এবং সামাজিক অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হয়।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক জরিপে প্রায় ২শ একর জমি সরকারের নামে ভুল বশত রেকর্ড করে দিয়েছে। তা ভাঙানোর জন্য আমরা আদালতে মামলা দায়ের করেছি।
স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুজ্জামান লেচু জানান, কয়েক মহল্লার একটি ছান্দ আছে। তারাই এ জঙ্গলটি নিয়ন্ত্রণ করে। বর্ষায় তারা এখান থেকে মাছ আহরণ করে। শুষ্ক মৌসুমে গাছ বিক্রি করে। এটি তাদের আয়ের একটি বড় উৎস। সরকার উদ্যোগ নিলে এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লক্ষ্মীবাউড় জলাবনে কর্মরত আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন নামের এক পাহারাদার জানান, জলাবন ও এর আশপাশ মিলে অন্তত দেড়শ পুকুর রয়েছে। এগুলোতে খাবার দিয়ে মাছ আটকে রাখা হয়। এ বছর বানিয়াচংয়ের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আতর আলী মিয়াসহ কয়েকজন মাছ ধরার জন্য এটি লিজ নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল জানান, চরম অযত্ন, অবহেলা ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বনটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অব্যাহতভাবে গাছ কাটার ফলে দিন দিন বনটি ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনই সরকার উদ্যোগ না নিলে দ্রুত এটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন মনীষ চাকমা জানান, স্থানীয় একটি চক্র পঞ্চায়েতের নাম দিয়ে এটিকে ব্যবহার করে প্রতি বছর অনেক টাকা আয় করে। অথচ হাওরাঞ্চলে পর্যটন যদি আরও জনমুখী করতে পারি তবে লক্ষ্মীবাউড় একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এফএ/এমএস