ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ধানের চারার সঙ্কট, ফসল উৎপাদন কমবে ৭৬ হাজার টন

জেলা প্রতিনিধি | সিরাজগঞ্জ | প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ০৩ অক্টোবর ২০১৭

চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের মালশিন গ্রামের কৃষক আবু রায়হান। তিনি প্রতি বছরই ৫০ বিঘা জমিতে রোপা আমন ধান আবাদ করেন।

যা থেকে উঠে আসে তার সারা বছরের খোরাক। কিন্তু এ বছর সিরাজগঞ্জে দ্বিতীয় দফা বন্যায় তার পুরো জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দিশাহারা মানুষটি বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও ধান আবাদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু দুই দফা বন্যায় ধানের পাশাপাশি জেলার প্রায় ৪৫০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হওয়ায় মিলছে না প্রয়োজনীয় চারা।

বাজারে কিছু চারা মিললেও তা বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি দামে। এবার চারা কিনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি টাকা দিয়ে। জেলার উল্লাপাড়ার বোয়ালিয়া, কাওয়াক মোড়, বড়হর, মোহনপুরসহ বিভিন্ন বাজারে রোপা ধানের চারা বিক্রি হচ্ছে প্রতি পন (৮০ আঁটি) ১২০০ থেকে ১৬০০ টাকায়।

গত বছর এ সময় কৃষকরা বাজার থেকে রোপা ধানের চারা কিনেছেন প্রতি পন জাতভেদে ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন বন্যায় জমির বীজতলা ডুবে যাওয়ায় চারার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ে প্রথম দফা বন্যায় সিরাজগঞ্জে প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১১৫ কোটি টাকা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ৯ হাজার ৭০০ কৃষক। প্রথম দফা বন্যার এ ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আগস্টে আবারো বন্যা দেখা দেয়। দুই সপ্তাহেরও অধিককাল স্থায়ী এ বন্যায় পানিতে নষ্ট হয় আউশ, রোপা আমন, বোনা আমন, সবজি, আখ, পাট, কলা ও বীজতলাসহ অন্যান্য ফসল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ১৩ হাজার ৬৮৭ কৃষক। আর সবমিলে দুই দফা বন্যায় জেলায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জ জেলায় দ্বিতীয় দফায় বন্যায় সদর, কাজিপুর, চৌহালী, বেলকুচি, শাহজাদপুর, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সদর, কাজিপুর, চৌহালী, বেলকুচি ও শাহজাদপুর উপজেলা। এতে ২৩ হাজার ৯০০ হেক্টর ফসলি জমি ও ২৭৫ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা নষ্ট হয়। আর প্রথম দফায় নষ্ট হওয়া বীজতলার পরিমাণ প্রায় ১৬০ হেক্টর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বিশেষ কর্মসূচির আওতায় এরই মধ্যে ৪০০ কৃষকের প্রত্যেককে এক বিঘা জমির জন্য প্রয়োজনীয় ধানের চারা বিতরণ করা হয়েছে। ১২০ কৃষকের প্রত্যেককে বিতরণ করা হয়েছে পাঁচ কেজি করে ধানের বীজ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে সবজির চারা তৈরি করে ৩৫ হাজার কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।

তাড়াশ উপজেলার কাজিপুর গ্রামের কৃষক মজনু সেখ, মনিরুজ্জামান, হায়দার জানান, বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আর এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদের দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। কারণ অনেক কৃষকই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আর যারা নতুন করে জমিতে ধান আবাদের চেষ্টা করছেন তারা পড়ছেন বীজ ও চারা সঙ্কটে। যা পাওয়া যাচ্ছে তার দামও আকাশ ছোঁয়া।

সগুনা ইউনিয়নের ওয়াশিন গ্রামের কৃষক জামাল ও হাসেম বলেন, বন্যার আগে প্রতি বিঘা জমিতে রোপা আমন আবাদ করতে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার টাকার মতো। কিন্তু বন্যার পর এ খরচ অনেক বেড়েছে। কেননা প্রয়োজনীয় ধানের চারা ও বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তা অত্যধিক দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

তারা জানান, তাদের মতো জেলার হাজার হাজার কৃষক এখন চারা সঙ্কটে ভুগছেন। জেলার কৃষকদের বাঁচাতে এখন বীজ, সার ও কৃষি উপকরণসহ সরকারের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

sirajgong2

বড়হর হাটে চারা কিনতে আসা চালা গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন বলেন, বন্যার কারণে ধানের চারার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যারা বাজারে চারা আনছেন তারা স্বাভাবিক বাজারের দ্বিগুণ বা তারও বেশি দাম হাঁকছেন। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে চারা কিনতে হচ্ছে।

চারা কিনতে আসা সরফত আলী বলেন, ধানের চারা স্বাভাবিক বাজারে ৪০০-৫০০ টাকা পণ বিক্রি করা হয়। কিন্তু বর্তমান বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৬০০ টাকায়।

তিনি আরও বলেন, বন্যায় ধানখেত পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ক্ষতিসাধন হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে চাষাবাদ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু শুরুতে চারার সঙ্কট ও চড়া দামে চারা কিনতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে।

চারা বিক্রেতা হোসেন আলী বলেন, বন্যার পানিতে ডুবে জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। ভাসমান অবস্থায় যে চারা আছে সেগুলো বিক্রি করতে এসেছি। এবার বন্যার কারণে চারার দাম একটু বেশি হচ্ছে।

উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খিজির হোসেন প্রামাণিক জানান, পর পর দুইবার বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলার ১২০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকজন উঁচু জায়গায় এবং ভাসমান প্রক্রিয়ায় চারা উৎপাদন করতে পেরেছেন, সেগুলোই এখন বাজারে আসছে। স্থানীয়ভাবে এসব চারা কৃষকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। তারপরও পাবনা ও বগুড়া থেকে ধানের চারা আমদানি করা হচ্ছে। তবে এসব চারার মূল্য পড়ছে অনেক বেশি। ফলে সাধারণ কৃষকদের জন্য চারা ক্রয় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আরশেদ আলী বলেন, দুই দফা বন্যায় জেলায় প্রায় ২৪ হাজার কৃষক সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এর বাইরে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আরও প্রায় ১ লাখ। এ অবস্থায় এবার প্রায় ৭৬ হাজার টন ফসলের উৎপাদন কম হতে পারে।

ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, রোপা আমন ও বীজতলাসহ কৃষকের বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে রোপা আমন আবাদের জন্য বীজতলা তৈরি করতে সময় লাগবে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে কৃষকদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া এরই মধ্যে কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে ধানের চারা ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। ৩ কোটি টাকা প্রণোদনাও দেয়া হয়েছে। আর এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

ইউসুফ দেওয়ান রাজু/এএম/এমএস