পাড় ভেঙে স্বপ্ন ভাঙছে মধুমতি নদী পাড়ের মানুষদের
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মধুমতি নদীর পাড়ের বাসিন্দারা ভাঙন আতঙ্কে ভয়াবহ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও উপকার হয়নি নদী পাড়ের বাসিন্দাদের।
প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে মধুমতি নদী সংলগ্ন লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর, মাকড়াইল, মঙ্গলহাটা, মহাজন, শালনগর, ধানাইড়, বকজুড়ি, রামকান্তপুর, আমডাঙ্গা, বারইপাড়া, এলাকা ভাঙনের মুখে পড়ে নদীগর্ভে চলে যায় বাড়িঘর, গাছপালা বাজারসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শত শত একর ফসলি জমি।
এ বছর ভাঙনের মুখে রয়েছে মাকড়াইল প্রাইমারি স্কুল, কালনা সরকারি প্রাইমারি স্কুল, টি-করগাতী সরকারি প্রাইমারি স্কুলসহ লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার অনন্ত ২০টি গ্রামের বাড়ি-ঘরসহ শতশত একর ফসলি জমি।
যেকোনো সময়ে মধুমতী নদীর গর্ভে চলে যাবে এলাকার কাঁচাপাকা বাড়িসহ শত শত একর ফসলি জমি। গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময় ভাঙন রোধে অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয় করলেও বেশিরভাগ টাকাই এলাকার কোনো কাজে লাগেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ভাঙন রোধে গত ১০ বছরে কয়েক ধাপে মহাজন বাজারে নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ করা হয়। এসময় ৭ কোটি টাকাসহ প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে ভাঙনরোধে। এছাড়াও লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলায় ১০টিরও বেশি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় এলাকার নদীতীরের মানুষরা অভিযোগ করে জাগো নিউজকে জানান, নদী ভাঙন রক্ষায় সরকার টাকা খরচ করলেও ঠিকাদারদের অনিয়মের কারণে নদী ভাঙনরোধে তাদের কোনো উপকারে আসেনি।
সরেজমিনে লোহাগড়া উপজেলার টি-করগাতী সরকারি প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে জানা গেছে, গত বছর বর্ষা মৌসুমে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের সরিয়ে অন্যত্র ক্লাস করানো হলেও এ বছর বর্ষায় ভাঙনের মুখেই টি-করগাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে।
কোমলমতি ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন এ বিদ্যালয়ে আসে আর নদীতীরে দাঁড়িয়ে দেখে তাদের স্কুল কবে গ্রাস করবে মধুমতি নদীর ভাঙন। ইতোমধ্যে স্কুলের বাথরুম, টিউবওয়েল নদীতে চলে গেছে। চলে গেছে শিশুদের খেলার মাঠো। আর কয়েকদিন পরেই নদী ভেঙে ফেলবে তাদের প্রিয় ক্লাসরুম আর অবশিষ্ট খেলার মাঠ। ভয়ে আর আতঙ্কে রয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। ওপরের মহলে জানানো হয়েছে, ওপরের মহল থেকে পরিদর্শন করে স্কুল নিলাম করে নতুন জায়গায় স্কুল সরানোর পরিকল্পনা চললেও কবে আবার নতুন ভবন হবে এবং চালু হবে শিক্ষা কার্যক্রম তা জানে না কোমলমতি শিশুরা ।
সরেজমিনে দেখা যায় লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর বাজার এলাকায় প্রায় ৫০ বছর ধরে ভাঙছে মধুমতি নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ আমলের শিয়েরবর বাজার। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার এই বিশাল বাজারটি একটু একটু করে ভাঙতে ভাঙতে প্রায় শেষের পথে।
গত বছর তীব্র ভাঙনে নদী পাড়ের বাজারের ৩টি চান্দি, অন্তত ৩৫টি দোকান আর শতাধিক বসতবাড়িসহ একটি রেস্ট হাউস, পাঠাগার আর মসজিদ চলে গেছে মধুমতি নদীর মধ্যে। এলাকার শিশুদের জন্য একমাত্র সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়টি ও মধুমতি নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।
এ বছর মধুমতি নদীর ভাঙনে, শিয়েরবর অংশে ১ কিলোমিটার এলাকায় নারায়ন চৌধুরী, কার্তিক চৌধুরী, বাসুদেব চৌধুরী, কুতুব মোল্যা, আতিয়ার শেখ, তারা আলী, আতর আলীসহ অন্তত ১০০টি পরিবারের বসত ভিটা বিলীন হয়ে গেছে। আর বাকি সম্বলটুকু ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য পরিবারের লোকরা দিনরাত কাজ করছেন শেষ সম্বলটুকু বাঁচানোর জন্য।
আর আশ্রয় খুঁজছেন নতুনভাবে বাঁচার জন্য। বছরের পর বছর ধরে নদী ভাঙনের মধ্যে বাস করা এসব মানুষরা এবারের ভাঙনের পরে আর নতুন কোনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে উদভ্রান্তের মতো আশ্রয় খুঁজছেন। ভাঙন এলাকার মানুষের প্রত্যাশা নদী ভাঙন ঠেকাতে সরকারভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে।
এলাকার বাসিন্দা রকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, রাজনৈতিক দলের লোকেরা ভোট নেয়ার সময় খোঁজ খবর নেয় কিন্তু ভোট হয়ে গেলে নদী ভাঙন এলাকার নিপীড়িত মানুষের কোন খোঁজ নেয় না।
নড়াইল পওর উপ-বিভাগ, বাপাউবো উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অমৃত কুমার দাস জাগো নিউজকে জানান, আমরা বিষয়টি উপর মহলে জানিয়েছি বরাদ্দ পাওয়া গেলে যথাসময়ে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দীর্ঘদিন ধরে মধুমতি নদী ভাঙন কবলিত শিয়েরবর বাজার রক্ষায় নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ যে আশার কথা শোনালেন তাতে প্রকল্প আর ফান্ড হলে এক বছরের মধ্যে ভাঙন ঠেকানো যাবে। ততদিনে হয়তো শিয়েরবর বাজারের কোন অস্থিত্বই থাকবে না আর নতুন করে উদ্বাস্তু হবে কয়েক হাজার মানুষ ।
হাফিজুল নিলু/এমজেড/এমএস