গোছানো সংসার তছনছ করেছে মিয়ানমার সেনারা
‘সবকিছুই সাজানো-গোছানো ছিল। গরু-ছাগল, পুকুরে মাছ ও ৫ একর জমির ফসল নিয়ে ভালোই কেটেছে বাবা-মা, দুই বোন ও তিন ভাই নিয়ে ৭ জনের সংসার। কিন্তু শুক্রবার (২৫ আগস্ট) ভোর রাতে সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে। ২০-২৫ জনের সেনা ও মগ তরুণের দল বাড়িতে আক্রমণ চালায়। বাবা-মাকে উঠানে বের করে গুলি করে মারে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ি ৫ ভাই-বোন। কে কোন দিকে দৌড়েছি বলতে পারি না।’
মিয়ানমারের মংডু বলিবাজার ঝিমনতলী এলাকার তাহের মোস্তফা ও সুফিয়া খাতুনের ছেলে মুজিব উল্লাহ (২২) বৃহস্পতিবার দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি এলাকায় তার বাংলাদেশে আসার পরিস্থিতি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন।
তিনি আরও বলেন, পালানোর সময় অাকস্মিক একটি বুলেট আমার ডান গালের মাংস ছুয়ে চলে গেল। এরপরও দৌড় থামেনি। পেছনে তাকিয়ে দেখি ভিটে থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। এরপর বাংলাদেশমুখি মানুষের স্রোতে মিশে সীমান্ত পর্যন্ত এসে আটকে গেছি। বুধবার ভোরে টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি হই।
শুধু মুজিব নয় এভাবে আহত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চিকিৎসা নিচ্ছেন মংডুর ফকিরপাড়ার চিকনছড়ির আমির হোসেনের ছেলে আমান উল্লাহ (২৫)। তাদের ৮ জনের পরিবারের সবাইকে শনিবার রাতে ধরে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে মিয়ানমারের সেনারা। এ সময় পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বাড়ির বাকিদের অবস্থান বা পরিণতি কী হয়েছে জানেন না তিনি।
একই এলাকার আবদুস সালামের ছেলে মো. হোসেন (৩০) ও আয়ূব (২৬) বোমার স্প্লিন্টারে আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সৈয়দ উল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ ফারুককে (২৮) দুই পায়ে কুপিয়েছে রাখাইন তরুণরা। মংডুর হাতিপাড়ার রশিদ উল্লাহর ছেলে জুনায়েদ (২৬) ও আবদু জাব্বারের ছেলে ছাদেক (২০) বাড়িঘর ও স্বজনদের হারিয়ে আহতাবস্থায় বুধবার বাংলাদেশে ঢুকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এদের মাঝে বোমায় আহত জুনাইদ ও ছাদেক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন বলে জানান শাহাব বাজার এলাকার আবদুস শুক্কুরের ছেলে মকতুল হোসন।
তেমনিভাবে নিজ স্বামীকে হারিয়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে পাড়ার লোকদের সঙ্গে পালিয়ে এসেছেন ঢেঁকিবনিয়া মিয়াবাজার এলাকার আবদু রশিদের স্ত্রী মর্জিনা আকতার (২৮)। কোলে ৬ মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে ভিন দেশে এসে একলা অথৈ সাগরে পড়েছেন তিনি। কুতুপালং বস্তির বাইরে আমগাছ তলায় অন্যদের সঙ্গে অবস্থান নিলেও তার চোখে-মুখে নির্ভরতা হারানোর বেদনা যেন উপস্থিত সবাইকে ব্যথিত করছে। শনিবার ভোররাতে মিয়ানমার সেনাদের নির্মমতার কথা তিনি বলতে গিয়েই কান্নার ভেঙে পড়েন। এখানে শিশু সন্তানটি নিয়ে একলা কী করবে, ভবিষ্যত কী অপেক্ষা করছে এসব চিন্তায় দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে মর্জিনার।
মিয়ানমারের মেদিনিপাড়ার বাসিন্দা দিল মোহাম্মদ বলেন, তাদের আশপাশের ১২টি গ্রামের ১০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে সীমান্ত এলাকায়। তারা গত ৬ দিন ধরে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করছে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের ক্যাম্পে ৪০ হাজারের মত রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ঢুকে পড়েছে।
বালুখালী বস্তির লালু মাঝি জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এ বস্তিতে ১৮শ পরিবারের প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে। তারা নিজেরা বা পরিচিতরা ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে। নির্যাতিত এসব রোহিঙ্গারা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা গরু, ছাগল ও অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রী লুট হওয়ায় চরম হতাশ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে রেজু আমতলী, বাইশপারী, আঞ্জুমান পাড়া, কলাবাগান, মাঝের পাড়া, তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বৃহস্পতিারও এপারে ঢুকেছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে পলিথিনের তাবু টানিয়ে বৃষ্টিতে মানবেতর দিনযাপন করছে তারা। আনুমানিক ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ঠেকিয়ে রেখেছে বিজিবি। তবে এদের মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়া অনেক রোহিঙ্গাদেরকে বিজিবি চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।
৩৪ বিজিবির চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম বলেন, নানা রোগের চার শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়েছে।
রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে সীমান্তে গেছে প্রতিনিধি দল। তুমব্রু জিরো পয়েন্টে আটকা পড়া রোহিঙ্গাদের স্থানীয় লোকজন পানি ও শুকনা খাবার দিয়ে সহায়তা করছে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, কোনো রোহিঙ্গাদের এপারে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। মিয়ানমারে অরাজকতা চলার কারণে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা এখনো আগের অবস্থায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/জেআইএম