ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বেটিক বাইরোত পড়বার পাবু না ভালো ঘর দেকি বিয়ে দে

প্রকাশিত: ০৭:১৪ এএম, ০৭ জুন ২০১৫

কুড়িগ্রামের অদম্য পাঁচ মেধাবী জয় করেছে দরিদ্রতাকে। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, দিনমজুর, ভ্যান চালকের সন্তান প্রতিকূল পরিবেশ পেরিয়ে এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছে। এদের সবার পরিবারে অভাব অনটন যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো দু`বেলা আবার কখনো দু`মুঠো খাবার জোটেনি তাদের ভাগ্যে। চাহিদা মতো জোগাড় হয়নি পোশাক, বই-খাতা-কলম। তবুও থেমে যায়নি ওরা। হার মানেনি দরিদ্রতার কষাঘাতের কাছে। তারা সব বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে স্বপ্ন দেখছে ডাক্তার, প্রকৌশলী অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার।

এ প্রত্যাশা পূরণের মাঝে আবারো দারিদ্র্যই বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে মেধাবী যোদ্ধাদের সামনে। তাই সন্তানদের সাফল্যের মাঝেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবকরা।

তাছমিন নাহার
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেগম নুরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগের একমাত্র জিপিএ-৫ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন তাছমিন নাহার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাছমিন নাহারের। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটে  তাদের। সদর উপজেলার মোগলবাসার কৃষ্ণপুর গ্রামের সেনেরখামার এলাকার ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি তাইমুর রহমানের মেয়ে তাছমিন নাহার এই কৃতিত্ব অর্জন করে গোটা স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা তাছমিন নাহার উচ্চশিক্ষা নিয়ে সঙ্কটে পড়েছে। অর্থাভাবে তার কলেজে ভর্তি অনিশ্চিত এখন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অধরাই না থেকে যায়। দরিদ্র এই পরিবারের প্রতি সরকার ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন অসহায় পিতা তাইমুর রহমান ও তার মেয়ে।  

আইরিছ আক্তার
চিলমারী উপজেলার মাচাবান্দা শিমুলতলা গ্রামের দিনমজুর আব্দুল আজিজের ৪ সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে আইরিছ। আব্দুল আজিজের নিজের কোনো জমি নেই। ভূমিহীন এ মানুষটির দু`হাতের ওপর নির্ভ রশীল ৬ জনের ভরণ-পোষণ। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গোটা পরিবারকে থাকতে হয় উপোস করে। তার ওপর সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় তাকে। শুধুমাত্র অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরেই আইরিছ আক্তার এবারে এসএসসি পরীক্ষায় থানাহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অনাহার-অর্ধাহার থেকে শত সঙ্কটের মধ্যেও ঈর্ষণীয় সফলতায় গোটা পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে সে। কিন্তু হাসি নেই কারো মুখে। কারণ উচ্চশিক্ষা যে অনিশ্চিত। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। হয়তো সে কারণে অনিশ্চয়তার মাঝেও আইরিছের ইচ্ছা পড়াশুনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে।

স্কুল শিক্ষক সাহিনুর ইসলাম মুক্তা জাগো নিউজকে জানান, খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে এই অর্জন মেয়েটির। লেখাপড়ার জন্য স্কুল থেকেও তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু আগামীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য তার প্রয়োজন সরকারি কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। তা না পেলে বন্ধও হয়ে যেতে পারে মেয়েটির মেধার বিকাশ।



লাকী আক্তার
চলতি এসএসসি পরীক্ষায় চিলমারী থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে লাকী আক্তার। উপজেলার উত্তর মাছাবান্দা ডম্পোড় মোড় এলাকার দিনমজুর আইয়ুব আলীর ছোট মেয়ে লাকী আক্তার। সম্পদ বলতে একটুখানি বাড়ি-ভিটা। অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করে চলে আইয়ুব আলীর টানাটানির সংসার। ৩ কন্যাসহ ৫ জনের সংসার। তিন বেলা পেটপুরে খাবার জোটাই কঠিন। ধার-দেনা করে দুই মেয়ের বিয়ে দিলেও ছোট মেয়ের পড়াশোনার ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে হাজারো কষ্ট। এর মাঝেও লাকী চালিয়ে যায় তার পড়াশোনা। অভাবের সংসারে এ যেন পাহাড় ঠেলার সমান। বাবা আইয়ুব আলীর রাতে ঘুম হয় না মেয়ে লাকীর পড়ালেখা কীভাবে চালিয়ে যাবেন?

এ অক্ষমতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এদিকে এলাকায় মেয়েটির সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে কিছু লোক।  ‘এসএসসি পাশ করছে এইটাই বড় ব্যাপার। তোর তো অত টাকা পাইসা নাই, তুই বেটিক বাইরোত পড়বার পাবু না, তাই এ্ইসময় ভালো ঘর দেখি মেয়েটাক বিয়া দিয়ে দে। এইটাই ভালো হইবে।’ 

কিন্তু এত কথা শুনেও মেয়ে ভীত নয়। সে পড়তে চায়। করতে চায় সকল বাধা অতিক্রম। স্বপ্ন দেখে প্রকৌশলী হওয়ার। মেয়ের স্বপ্ন পূরণে প্রধান বাধা অর্থনৈতিক দীনতা। মা সাজেদা বেগম সংসারের অভাব দূর করতে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। শত কষ্ট হলেও মা সাজেদা বেগমের একটি চাওয়া মেয়ে যেন পড়ালেখা করে নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে পারে। তিনি দুঃখ করে বলেন, গরিব হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা অনেক। আর এ গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াবে সরকার, এমন প্রত্যাশা তাদের।

রোকছানা খাতুন
চিলমারী উপজেলার মাচাবান্দা তেলিপাড়া গ্রামের সফিউল ইসলামের মেয়ে রোকছানা খাতুন। ছোটবেলা থেকে সে স্বপ্ন দেখে আইনজীবি হবার। কিন্তু দারিদ্র্য তার স্বপ্নের মাঝে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায় রোকছানা। দারিদ্র্য এবং পারিবারিক নানা সঙ্কট বিকশিত হওয়ার পথকে সঙ্কুচিত করেছে। বাবা পেশায় দিনমজুর। ধার-দেনা ও অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ৬ জনের টানাপোড়েনের সংসার। সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়া ছেড়ে তার বড় ভাই দিনমজুর ও ছোট ভাই রিকশা চালিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তার ছিল না প্রয়োজনীয় বই-খাতা-কলম, এমনকি, পরনের পোশাক। যেখানে ডাল-ভাত জোটানো ভার সেখানে পুষ্টিকর খাবার তো আকাশের চাঁদ ধরার মতোই। রোকছানার ভাগ্যে শুধু ‘নেই’ আর ‘নেই’। শত প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে রোকছানা চলতি এসএসসি পরীক্ষায় থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে অবাক করেছে।



মোসলেমা আক্তার
চিলমারী উপজেলার থানাপাড়া গ্রামের বাবাহারা দুখিনী মোসলেমা আক্তারকে দিনের পর দিন অনাহারে থেকে যেতে হয়েছে স্কুলে। ছিল না প্রয়োজনীয় বই-খাতা-কলম। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল বড় কিছু হওয়ার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধান বাধা অর্থনৈতিক দীনতা। ভালো কোনো পোশাক জোটেনি তার কপালে। একমাসেও জোটে না এক টুকরো মাংস কিংবা দুধ। পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠেও অভাবের সংসারে আজ আলোকিত মোসলেমা।

দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। কয়েক বছর আগে বাবা মোক্তার আলী মারা গেলে পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তখন বড় ভাই ভ্যান চালিয়ে ও ছোট ভাই দিনমজুরের কাজ করে সংসারের হাল ধরেন। শত বাধা পেরিয়ে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় চিলমারী উপজেলার থানাহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোকেশনাল শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোসলেমা। ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চায় সে।

মফস্বলের অদম্য মেধাবীদের স্বপ্নে দারিদ্র্যের কালো মেঘ জমেছে ভবিষ্যতের চিন্তায়। সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতাই এখন শুধু পারে এই স্বপ্নবাজ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে নিতে।

এমজেড/পিআর/এসআরজে