হার্ডলাইনে প্রশাসন, তবুও বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হার্ডলাইনে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কিন্তু এরপরও বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। স্থল ও জল সীমান্তের কিছু কিছু পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে আবারো স্বদেশে ফেরত পাঠানো হলেও দুই দেশের সীমান্তের জিরোপয়েন্টে শত শত নারী-পুরুষ অবস্থান নিয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে বৃহস্পতিবার রাতে একসঙ্গে দুই ডজনেরও অধিক পুলিশ ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের হামলার পর সহিংসতায় অর্ধশতাধিক লোক মারা যায়। এরপর আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছাড়ছে সাধারণ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। নাফ নদীতে বিজিবি ও কোস্টগার্ড টহল অব্যাহত রেখেছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধে সেন্টমার্টিনে মাইকিং করা হয়েছে। রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে।
এদিকে যে কোনোভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উখিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এক জরুরি সভা শনিবার সকাল ১০টায় উপজেলা অফিসার্স ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিনের সভাপতিত্বে সভায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বলেন, কোনো অবস্থাতেই একজন রোহিঙ্গাকেও আর এদেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। মানবতার নামে আর কোনো সহযোগিতা নয়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যা কিছু সমস্যা তা তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। এদের আমরা আর আশ্রয় না দিলে মিয়ানমার তাদের বিষয়টি দ্রুত সমাধান করবে। তাই যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাদের কারণে নষ্ট হচ্ছে বনভূমি ও সংস্কৃতি। সবার সহযোগিতায় আমরা এ ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারি।
সভায় পরামর্শ দিয়ে বক্তব্য দেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছেনুয়ারা বেগম, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, রত্নাপালং ইউপি চেয়ারম্যান খাইরুল আলম চৌধুরী, পালংখালী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মোজাফ্ফর আহমদ সওদাগর, ধর্মীয় নেতা উখিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মৌলানা রফিক প্রমুখ।
এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরাজুল হক টুটুল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) চাউলাও মার্মা, উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের, বিজিবির মরিচ্যা চেক পোস্টের সুবেদার নজরুল ইসলাম, হলদিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম ও জালিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এত নজরদারির পরও স্থল ও জলসীমা পাড়ি দিয়ে উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে সমতল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে। ছোট ছোট নৌকায় করে নাফ নদী পার হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
স্থানীয়দের দাবি, শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালেও উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর কড়া নজরদারি এড়িয়ে ছোট ছোট নৌকায় করে রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এছাড়া স্থল সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়েও রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে।
যদিও বিজিবি ও প্রশাসন বলছে, সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে পারেনি। তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ রুখতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। একইসঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয়দের মাঝে সচেতনা সৃষ্টি করছে প্রশাসন।
সীমান্তে বসবাসকারী অনেকে জানিয়েছেন, শুক্রবার গভীর রাতে ও ভোরে উখিয়ার রহমতের বিল, বালুখালী কাটা পাহাড়, ধামনখালী, আঞ্জুমানপাড়া এবং টেকনাফের উলুবনিয়া, লম্বাবিল, ঝিমনখালী, উনচিপ্রাং, নাইটং পাহাড় ও হ্নীলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় কয়েকশ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
তবে বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিমের দাবি, বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) আরকানে সহিংস ঘটনার পর থেকে নাফ নদীর তীরে এসে যে হারে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছিল সেই উপস্থিতি অনেকটা কমে গেছে। সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে পারেনি। সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিজিবি সদস্যরা কড়া নজরদারিতে কাজ করছেন।
তিনি জানান, শুক্রবার দিবাগত রাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ড ৭৩ জনকে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে। কড়া নজরদারি থাকায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি।
কোস্টগার্ড ও বিজিবি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২০৮ কিলোমিটার স্থল ও ৬৩ কিলোমিটার জলসীমানা রয়েছে। শুক্রবার ১৪৬ জন এবং শনিবার সকাল পর্যন্ত ৭৩ জনকে আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে আবারো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আনান কমিশনের প্রতিবেদন হন্তান্তরের পর বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) রাতে মিয়ানমারের মংডুর নাইকাদং ও কোয়াংছিদং গ্রামে রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। পাল্টা আক্রমণ হয় দুই ডজনের অধিক পুলিশ ক্যাম্পে। এতে ১২ পুলিশসহ ৭১ জন নিহত হয়েছে।
এরপর থেকে রোহিঙ্গারা নিপীড়নের ভয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ মিয়ানমার। চলতি অস্থিরতায় আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকতে সীমান্তে জড়ো হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/আরআইপি