আতঙ্কের মাঝেও ছাউনির নিচে শান্তির ঘুম
রাতে চারপাশে সুনসান নীরবতা। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের প্রহরা নেই। নেই কোনো যানজট। ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক রাত ২টা ২০ মিনিট। ঠাকুরগাঁও শহরের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা তখন গভীর শান্তির নিন্দ্রায় রাত পার করছেন।
একই সময় মেঘের গর্জনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও শহরের টাঙ্গন নদীতে বন্যার পানির তীব্র স্রোতের শব্দে আতঙ্কিত বন্যা প্লাবিত এলাকার অসহায় মানুষ। গত দু’দিনের প্রবল বর্ষণে ঠাকুরগাঁও জেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের প্লাবিত এলাকায় প্রায় ৫ হাজার মানুষ তাদের স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবা ও গবাদিপশু নিয়ে একটু নিরাপদে থাকার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন গাছতলা, রাস্তার পাশে ও বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসনের খুলে দেওয়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। বন্যা কবলিত শহরের খালপাড়া এলাকায় টাঙ্গন নদীর রাস্তার পাশেই পলিথিনের ছাউনি তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টাঙ্গন নদীর রাস্তার পাশেই অনেক অসহায় মানুষ বৃষ্টি মোকাবিলায় ছাউনী ঠিক করতে ব্যস্ত। আবার কেউ ছাউনীর ভেতরে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধাসহ ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক মা তার প্রিয় সন্তানটি জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছেন, আবার কেউ স্ত্রীকে নিয়ে ক্লান্তির ঘুমে বিভোর। আর বয়স্ক পুরুষ অভিভাবক ও যুবকরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছাউনীর ভেতরে ঘুমন্ত মানুষদের পাহারা দিচ্ছেন।
ছাউনীর ভেতরেই একজন মা তার সন্তানকে ঘুম পাড়াতে বসে আছেন। ওই ছাউনীর ভেতরেই গবাদিপশুগুলোকে নিরাপদে রেখেছেন তিনি।
কথা বলতে গেলে ওই গৃহবধূ বলেন, বন্যা আমাদের জন্য অভিশাপ। বন্যায় ঘর-বাড়ি ডুবে যাওয়ায় কোথাও আশ্রয় না পেয়ে গাছের তলায় ছাউনী তৈরি করে রাত কাটাতে হচ্ছে দু’দিন ধরে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মানুষ খাবার দেওয়ার জন্য ব্যস্ত, কিন্তু আমাদের ছাউনীর ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের কেউ খোঁজ রাখছে না।
বৃদ্ধা আমেনা বেগম বলেন, বন্যায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে দু’তলায়, আর শেষ বয়সে আমাদের নিতে হয়েছে গাছ তলায়। গাছ তলার মানুষের কেউ খবর নিতে আসে না। সন্ধ্যায় ছোট একটা প্যাকেটে এলাকার জনপ্রতিনিধি খিচুড়ি দিয়ে গেছেন। যা মুখেই দেওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত সরকার দলের নেতাদের কাওকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে দেখলাম না।
খালপাড়া বন্যা কবলিত এলাকার সাইফুল আলম জানান, হঠাৎ একদিনে যে বন্যার পরিস্থিতি হয়েছে, আমরা কেউ সেটা ভাবতেই পারিনি। ঘর-বাড়ির সকল জিনিসপত্র রেখে স্ত্রী, সন্তান ও গবাদিপশুগুলোকে নিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছি। স্যানিটেশন ব্যবস্থা তেমন নেই। খাবার ও বিশুদ্ধ পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি ক্ষোভের সুরে জাগো নিউজের এ প্রতিনিধিকে বলেন, আমাদের এমপি রমেশ সেন বন্যার পরিস্থিতি দেখে ঢাকায় চলে গেছেন। সরকার দলের লোকজন ও অন্যান্যরা শুধু আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে খাবার দিচ্ছেন। আমাদের কাছে খাবার নিয়ে কেউ আসে না।
জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন অফিসের তথ্য মতে, জেলার ৫টি উপজেলায় ৪০টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ৪০ মে. টন চাল ও নগদ দেড় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়ালে’র কাছে আশ্রয় কেন্দ্রের মানুষের সহযোগিতার কথা জানতে চাইলে জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় ৬৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়াও শুকনো খাবার, পানি সরবরাহ ও মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের জন্য আরও চাহিদা দিয়ে ত্রাণ ও নগদ টাকা চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, উজান থেকে ধেয়ে আসা পানিতে শহরের টাঙ্গন নদীর তীরবর্তী জনবসতি গুলোসহ জেলার অন্যান্য ১০টি নদীতে রেকর্ড পরিমাণ পানি প্রবেশ করেছে এবারের বন্যায়। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
শহরের হঠাৎপাড়া, ডিসি বস্তি, সরকার পাড়া ও খালপাড়া, সদর উপজেলার আকঁচা, রায়পুর, মোহাম্মদপুর, সালন্দর, শুকানপুকুরী ও রুহিয়া, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রাণীংশকৈল উপজেলার আশেপাশের অনেক এলাকার বাড়ি-ঘর এখন পানির নিচে।
রবিউল এহসান রিপন/এফএ/জেআইএম