আদিবাসী দিবস কী? জানে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠী
কালামায়া তঞ্চঙ্গ্যা। ঘরে তার দুই ছেলে এক মেয়ে। তিন সন্তানই পড়ছেন জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ২০ বছর আগে রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি থেকে বান্দরবানে বালাঘাটায় এসে বসবাস শুরু করেন। আর গত বছর জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার বাঘমারা এলাকায় পাহাড়ের উপরে টিনশেড একচালা ঘরে বসবাস করছেন স্বামী-সন্তান নিয়ে। কিন্তু গত ক’দিন আগে ব্যাধিতে মারা গেছেন তার স্বামী। তাই এতদিনের হাসিমাখা মুখটি ফ্যাকাসে এখন, অনেকটাই নিষ্প্রভব। তবুও আদিবাসী দিবসের কথা বলতেই একটু ভ্রু কুচকেই চুলোয় আগুন দিতে দিতে আধো আধো গলায় পঞ্চান্ন বছর বয়সী কালামায়া বললেন, ‘আমি খেটে খাওয়া মানুষ। চাষ-বাস করে খাই। ওইসব আদিবাসি দিবস কী জানি না, শুনি নাই। অধিকার কী তাও জানি না।’
কালামায়ার মতো পাহাড়ের এ রকম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে জানেন না আদিবাসী দিবস কী? কী তাদের অধিকার? আর পার্বত্য শান্তি চুক্তির গুরুত্ব বা কী? রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুনপাড়া এলাকার ইউনিসেফ পরিচালিত পাড়া স্কুলের শিক্ষক হ্লাচ ইয়ন বলেন, ‘র্যালিতে যাই, সভায় অংশগ্রহণ করি ঠিকই, কিন্তু দিবসের গুরুত্ব কী সেটা সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। আগে জানতে হবে তারপরই তো আমরা আন্দোলন করতে পারব।’
রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুনপাড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা ব্যবসায়ী রে হ্লা অং বলেন, ‘এসব অধিকার সম্পর্কে আমাদের জানা নেই। আমাদের তো আগে জানতে হবে। দুর্গম এলাকাগুলোর মানুষ তো অধিকার, দিবস এবং শান্তি চুক্তি সর্ম্পকে জানে না।’
ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বৈষম্য-নিপীড়ন ও জাতিগত আগ্রাসনে ৭০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসির জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিলুপ্ত হয়ে যায় কোনো কোনো আদিবাসীর অস্তিত্ব। এই কারণে আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে আদিবাসী বর্ষ ও ১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পাশাপাশি জাতিসংঘ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার-বিষয়ক ঘোষণাপত্রও প্রণয়ন করেছে। এর আগে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বে নিয়ে আসার জন্য ১৯৯৫-২০০৪ সালকে প্রথম আদিবাসী দশক ও ২০০৫-২০১৪ সালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা বলা হয়েছে। আর আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিতে পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন সময়ে হয়েছে সভা-সমাবেশ। জাতীয়ভাবে এ দিবসটি পালিত না হলেও প্রতিবছর এই দিনে দিবসটি নানাভাবে পালন করে থাকে সমতল ও পাহাড়ে থাকা ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী। তবে এই দিবসের তাৎপর্যতা কী সে বিষয়ে জানা নেই খোদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর।
এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখতেই বান্দরবান আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক লেলুন খুমী বলেন, ‘আমরা নিজেরা যারা আদিবাসী বলে দাবি করি, আমরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখব। এছাড়াও যারা আমাদেরকে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী বানিয়েছে তাদের সম্পর্কে পার্বত্য জেলায় প্রান্তিক জায়গায় বসবাসকারী আদিবাসীরা জানে না। তারপরও আমরা যারা এসব বিষয়ে সচেতন আছি, প্রান্তিক পর্যায়ে আমরা মেসেজ দিতে চাই আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘সরকার সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাই সরকারের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে। আমরা আশা করব এই সরকার ভুল-বিভ্রান্তি বুঝতে পেরে অন্যান্য দেশের মতো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।’
বিএ