কেটে গেল ছয় বছর, হলো না কিছু্ই
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে পুলিশের উপস্থিতিতে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে (১৬) পিটিয়ে হত্যার ছয় বছর আজ। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্তৃক দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে সিআইডিকে পুনঃতদন্তের পর দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়ারও একুশ মাস কেটে গেছে এরই মাঝে। কিন্তু এখনো আদালতে সিআইডি সে রিপোর্ট জমা দেয়নি। দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে মামলাটির ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছে নিহত মিলনের স্বজন ও এলাকাবাসী।
তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মেদ জাগো নিউজকে জানান, ইতোমধ্যে তারা ঘটনার সময় মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও চিত্রটি সংগ্রহ করেছেন। এতে ঘটনার সময় কারা কারা ছিলেন তা শনাক্তসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোও সংগ্রহ করা হয়েছে। অতি দ্রুত সময়ে মিলন হত্যা মামলার পুনঃ তদন্তের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন।
এর আগে ২০১৫ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নোয়াখালী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) ওসি আতাউর রহমান ভূঁইয়া ভিডিওচিত্র দেখে হত্যার ঘটনায় শনাক্ত হওয়া ২৭ ব্যক্তি ও চার পুলিশ সদস্যসহ ৩২ জন আসামির সবাইকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে নোয়াখালীর ২(দুই) নম্বর আমলি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা ভিডিওচিত্র দেখে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত ২৭ জন আসামি এবং এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মামলার দায় হতে অব্যাহতির আবেদন করেন।
এছাড়া উল্লেখিত ২৭ জন আসামির মধ্যে একজন (শাহ আলম) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানের বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিলো। প্রতিবেদনে বাদীর মামলা না চালানোর আবেদনের বরাত রয়েছে। পাশাপাশি ‘এজাহারে বর্ণিত ঘটনা সত্য ঘটনা বলিয়া প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও কে বা কারা উক্ত ঘটনা করেছে তা প্রমাণ করার মত পর্যাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোনো স্বাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় ভবিষ্যতে মামলা প্রমাণ করার মত স্বাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে বলে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
কিন্তু ওই বছরের ৫ নভেম্বর নোয়াখালী ২ (দুই) নম্বর বিচারিক আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট্র ফারহানা ভূঁইয়া ডিবি-পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে প্রতিবেদন গ্রহণ না করে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য জেলা সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সে নির্দেশেরও একুশ মাস কেটে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর কাঁকড়া ইউনিয়নের লোকজন ২০১১ সালের ২৭ জুলাই ছয় ডাকাতকে পিটিয়ে হত্যা করে। কিশোর মিলন ওইদিন সকালে চর ফকিরা গ্রামের বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে যাচ্ছিলেন। পথে চর কাঁকড়া একাডেমি স্কুলের সামনে থেকে একদল লোক তাকেও ডাকাত সন্দেহে আটক করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন।
এসময় কোম্পানীগঞ্জের তৎকালীন এসআই মো. আকরাম শেখের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মিলনকে থানায় না নিয়ে ডাকাত সাজিয়ে চরকাঁকড়া ইউনিয়নের টেকের বাজারে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেন। এরপর লোকজন নিরাপরাধ কিশোর মিলনকে পুলিশের উপস্থিতিতে পিটিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। ঘটনার কয়েকদিন পর মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিওচিত্রে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে। এনিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে।
নিহত মিলনের মা কহিনুর বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাগো নিউজকে জানান, তার নিরপারাধ ছেলে মিলন হত্যার ছয়টি বছর পার হয়ে সাত বছরে পড়লো। ঘুমের ঘোরে এখনও ছেলেকে দেখতে পান। কিন্তু ছেলেতো নেই। ছেলে হত্যার বিচারের আশায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরেছেন। ডিবি পুলিশের কাছে বার বার ধরণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ৫২ বার আদালত থেকে সময় নিয়েও আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি ডিবি-পুলিশ। সিআইডিকে মামলার তদন্ত করতে দেয়ারও ২১ মাস পার হয়ে গেলো। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তার স্বামী সৌদি আরবের চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসেন। চার মাস আগে তিনিও মারা গেছেন। জীবিত থাকা অবস্থায় ছেলের হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি। ছেলে হত্যার বিচারের পাশাপাশি তার অন্য এক ছেলেকে চাকরি দেয়ার যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল সেটি পুরনের দাবি জানান। বর্তমানে তিনি তিন ছেলেকে নিয়ে সংসার করছেন।
নিহত মিলনের ছোট ভাই সালাউদ্দিন পাভেল বলেন, তার ভাইকে হত্যার পর অনেকে এসে সান্তনা দেয়াসহ নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার বাবাকে পুলিশ নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু অভাব অনটনের সংসারে এবং তাকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় এবং নানামুখী চাপ দেওয়ায় তার মাকে দিয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজী করানো হয় এবং তিনি রাজীও হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই হয়নি। না ভাই হত্যার বিচার না তার চাকরি। এখন গোটা সংসার তার ওপরে। তার আরো দুই ভাই রয়েছে।
বাদী পক্ষে মামলার আইনজীবী নোয়াখালী জেলা মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাড. কল্পনা রানী দাস জাগো নিউজকে জানান, আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ মামলাটির অধিকতর তদন্তের রিপোর্ট প্রাপ্তির দিন ধার্য রয়েছে আদালতে। ইতোমধ্যে সিআইডি অধিকতর তদন্তে প্রতিবেদন আদালতে জমা না দেয়ায় বার বার তাদের সময় দেয়া হয়েছে।তিনি দ্রুত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়াসহ বাদীর পক্ষে মামলাটির ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেন।
নোয়াখালী জজ কোর্টের আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাড. এটিএম মহিব উল্যাহ তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে জানান, মিলন হত্যা মামলাটি চাঞ্চল্যকর একটি মামলা। পুলিশ চার বছর ধরে তদন্ত করে আসামি ট্রেস আউট করতে না পারায় ফাইনাল রিপোর্ট দেন। তারা রির্পোটে উল্লেখ করেন ঘটনার সময় তারা পরিস্থিতির শিকার। তাদের ওপর আক্রমণ করে জোরপূর্বক মিলনকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। এসময় তারা কাউকে চিনতে পারেননি।
আদালতে দাখিলকৃত এ রির্পোটে বাদী নারজি দেয়ায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট নথি পর্যালোচনা করে পুনঃতদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডি এখনো প্রতিবেদন দাখিল করেননি।
তিনি আরো জানান, রির্পোট আসলে বাদীর ন্যায় বিচার পেতে কোনো বিঘ্ন হবে না।
মিজানুর রহমান/এফএ/পিআর