হাসপাতালে অবহেলায় পড়ে আছেন নারী বীরপ্রতীক
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা বীর যোদ্ধা, বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি বীরপ্রতীক এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ বীরকন্যার শরীর এখন নিস্তেজ। কথা বলতে পারেন না। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর শয্যায় তিনি চিকিৎসাধীন।
কাঁকন বিবির একমাত্র মেয়ে সকিনা বিবি জানান, গত বুধবার তিনি ব্রেনস্ট্রোক করার পর থেকে তার শরীর অনেকটাই নিস্তেজ। কাঁকন বিবির শ্বাসনিশ্বাস চলাচল করছে যেন ধীরগতিতে।
গত শুক্রবার তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখনো তার ভাগ্যে একটি কেবিন জুটেনি। দেশের জন্য ৭১ জীবন বাজি রেখে মরণপণ যুদ্ধ করলেও আজ স্বাধীন দেশে তার চিকিৎসা চলছে অন্যসব সাধারণ রোগীর মতো।
শনিবার সন্ধ্যায় ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কাঁকন বিবির শয্যাপাশের দেয়ালে তেলাপোকা ঘুরাঘুরি করছে। এমন পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তার একমাত্র মেয়ে সখিনা।
তিনি বলেন, জন্মের পর আমি দিনের বাচ্ছা। মাকে মাত্র তিনদিন কাছে পেয়েছি। তিন দিনের সন্তান রেখে মা যুদ্ধে যায়। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। আজ আমার মায়ের চিকিৎসা এভাবে হচ্ছে আমি অবাক হচ্ছি। কিছু বলার ভাষা নেই আমার।
তিনি বলেন, আমার মায়ের উন্নত চিকিৎসা হলে সুস্থ হবে। আমার সন্তান নেই, আমার মা আমার সব। আমি মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারর সহযোগিতা চাই।
ওসমানী হাসপাতালের উপপরিচালক ডাক্তার দেবপদ রায় বলেন, তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তা আমার জানা ছিল না। এমন একজন রোগীকে সেবা করা আমাদের ভাগ্যের বিষয়।
তিনি বলেন, অবশ্যই রোববার সকালের মধ্যে এ মহিয়সী নারী যোদ্ধার জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সকল রোগীর জন্যই আমরা সেবক হিসেবে কাজ করি। তার চিকিৎসায় কোনো ধরনের অবহেলা হবে না।
কাঁকন বিবি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে।
১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে কাঁকন বিবির বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম পরিবর্তিত হয়। নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।
কাঁকন বিবি তিন দিনের কন্যা সন্তান সখিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান। তিনি ছিলেন বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেননি। সেই সঙ্গে করেছেন সম্মুখযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়।
কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়। পরবর্তীকালে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করার পরে তিনি আগের স্বামীর ঘর থেকে মেয়ে সখিনাকে নিয়ে আসেন। মেয়েকে নিয়ে এসে তিনি স্বামীকে খোঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন।
সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে মেয়েকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাস তখন।
পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন তিনি। তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাকে। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তখনই কাঁকন স্বামীকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেন। জুলাই মাসে তার সঙ্গে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড়ের।
কাঁকন বিবি শুরু করেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করার। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সফল হন।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন তিনি। এবার একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা তাকে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেয়া হয় ছ্যাঁকা। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে পাকিস্তানি বাহিনী ফেলে রেখে যায়। তাকে উদ্ধার করে বালাট সাব-সেক্টরে নিয়ে যাওয়া হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে যান বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন।
মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর তাকে প্রশিক্ষণ দেন। এর পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখযুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। কাঁকন বিবি প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন। বর্তমান সরকার তাকে বীরপ্রতীকের স্বীকৃতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে সখিনা।
ছামির মাহমুদ/এএম/আরআইপি