ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দারিদ্রতা কমাচ্ছে মাশরুম চাষ

প্রকাশিত: ০৭:২৫ এএম, ২৬ মে ২০১৫

মধ্যবয়সী অমূল্য ধন চাকমা। বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাঙামাটি শহরের সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে। গ্রামের বাড়ি জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়ি সদরে। মাশরুম চাষই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। মাশরুম চাষ কীভাবে তার ভাগ্য পরিবর্তন করলো এ গল্প জাগো নিউজকে শোনালেন তিনি।

বর্তমানে অমূল্য ধন চাকমার জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মাশরুম চাষ। তিনি বলেন, বেকারত্বের অভিশাপ মোচন করতে তিনি এ পেশায় এসেছেন প্রায় ১৩ বছর আগে। ইতোমধ্যে এ পেশায় স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে ঘরে বসেই তার মাসিক গড় আয় প্রায় লাখ টাকার উপরে। নিজ বাড়িতে মাশরুমের চাষ করেন তিনি। আর এতে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন তার সহধর্মিনী নীহারিকা চাকমা। পরিশ্রম একদম স্বল্প পরিসরের। পুঁজিও নেহাত কম। কিন্তু লাভ অধিক। স্বামী-স্ত্রী মিলে পারিবারিকভাবেই মাশরুম চাষ করেন অমূল্য ধন চাকমা ও নীহারিকা চাকমা। বাজারেও মাশরুম বিক্রি করতে যান দুজনেই।

অবশ্য ভাগ্য পরিবর্তনের গল্পটা এখন শুধুই অমূল্যের নয়। এই গল্পটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। মাশরুম রাঙামাটির অনেক লোকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। বলা যায়, মাশরুম চাষে নীরব বিপ্লব ঘটছে এই পার্বত্য জেলায়। স্বাবলম্বী হয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতদরিদ্র ও বেকার মানুষ। এতে অভাব-অনটন দূর হয়ে তাদের পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা।

একই জায়গায় পাশাপাশি বসবাস করেন অমল কান্তি চাকমা। তিনি রাঙ্গামাটি সদরের কুতুকছড়ির একটি মৌজার প্রধান বা হেডম্যান। আরেক মাশরুম চাষি ননী জীবন চাকমা। তিনি একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। অমূল্য ধন চাকমার সাফল্য দেখে তারাও ঝুঁকে পড়েন মাশরুম চাষে। এতে অভাবনীয় সাফল্য আসে তাদেরও। পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। বর্তমানে মাশরুম চাষে তাদের মাসিক গড় আয় প্রায় ৩০-৫০ হাজার টাকা।

তারা বলেন, মাশরুম চাষে তাদের প্রত্যেকের জীবনে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। মোচন হয়েছে বেকারত্বের অভিশাপ। দূর হয়েছে সংসারের অভাব-অনটন। আর বদলে যাচ্ছে ভাগ্যের চাকা। এক সময়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে দারুণ হিমশিম খেতে হতো। এমনকি বিক্রি করে দিতে হয়েছে ভিটে-বাড়ি পর্যন্ত। এখন মাশরুম চাষে দূর হয়েছে অভাবের অভিশাপ।

বসতবাড়ি ও আশপাশের আঙিনায় স্বল্প পুঁজিতে অতি সহজেই মাশরুম চাষ করা যায়। পরিশ্রমও একেবারেই কম। বর্তমানে রাঙ্গামাটিসহ পাহাড়ে মাশরুমের চাহিদা অনেক। কিন্তু এরপরও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। বীজের অভাবে ব্যাপকহারে মাশরুম চাষ করতে পারেন না চাষীরা। স্থানীয়ভাবে সরকারের কৃষি বিভাগের একটি মাশরুম উপকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু সেখানে বীজ উৎপাদন হয় কম। অথচ মাশরুম চাষে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সাফল্যসহ আত্মকর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বী হতে রাঙ্গামাটিসহ পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

স্পন সংগ্রহ করার পর ধানের খড় সিদ্ধ করে স্পনের বীজগুলো পলিথিনের প্যাকেটে ভরে মেঝেতে অথবা মাচায় শুকনা জায়গায় রেখে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এরপর ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফলন আসতে শুরু করে। ওই সময় শুধু সকাল-বিকেল পানি ছিটাতে হয় মাশরুমের প্যাকেটগুলোতে। কয়েক দিন পর ফলন পরিপক্ক হলে মাশরুম তুলে বিক্রি করা যায়। প্রতি বীজ স্পনের দাম পড়ে প্রায় বিশ টাকা। প্রতি স্পন থেকে মাশরুম উৎপাদন হয় ৫-৬ কেজি।  বীজ স্পনসহ প্রতিটি প্যাকেটে সব মিলিয়ে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৫০-৬০ টাকা। আর প্রতি কেজি মাশরুম স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা।

প্রয়োজনীয় সহায়তা ও চাহিদা অনুযায়ী বীজ সহজলভ্য হলে মাশরুম চাষ হতে পারে পার্বত্য এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনের অন্যরকম চালিকা শক্তি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাঙ্গামাটিতে মাশরুম চাষে নীরব বিপ্লব ঘটতে শুরু করেছে। গবেষক, চাষী ও কৃষিবিদরা এ সম্ভাবনার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ কথা সরাসরি স্বীকার করেছেন সরকারের কৃষি বিভাগের রাঙ্গামাটি মাশরুম কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।  
 
রাঙ্গামাটি মাশরুম উপকেন্দ্রের সহকারী মাশরুম কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, রাঙ্গামাটিতে মাশরুম চাষে ব্যাপক সফলতা আসায় এটি একটি জনপ্রিয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে মাশরুমের চাহিদাও প্রচুর। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন আরো কম। সেজন্য মাশরুম চাষে এগিয়ে এসেছেন প্রচুর কর্মহীন মানুষ। আর এতে দ্রুত স্বাবলম্বী হতে সক্ষম হচ্ছেন তারা।

বীজ উৎপাদন সঙ্কটের কথা স্বীকার করে এই মাশরুম কর্মকর্তা বলেন, চাহিদার তুলনায় আমরা চাষিদের মাঝে পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করতে পারি না। সরকারিভাবে বরাদ্দ কম পাওয়ায় ব্যাপকহারে মাশরুমের বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। রাঙ্গামাটির এই মাশরুম উপকেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে বীজ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ৫০০ স্পনের। কিন্তু বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে উৎপাদন করা যাচ্ছে কেবল এক-দেড়শ বীজস্পন। বীজ উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যায় তিন মাসে মাত্র ৫০ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে ব্যাপকহারে মাশরুমের চাষ বেড়েছে। এর কারণ লাভ অধিক। স্বল্প পূঁজি আর স্বল্প পরিশ্রম। চাহিদাও অনেক। আমরা চাষিদের মাঝে প্রশিক্ষণসহ প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকি। আগ্রহী চাষিদের মাঝে বিনা সুদে ঋণ ব্যবস্থার জন্য প্রশিক্ষণ শেষে সনদ দেয়া হয়। চলতি বছর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে বিনা সুদে ৫০ মাশরুম চাষিকে ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের সনদ প্রদর্শনে যে কোনো ব্যাংক থেকেও চাষিদের মাঝে ঋণ বিতরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার চাষিকে মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে রাঙ্গামাটিতে।

এছাড়া ‘তবলছড়ি মাশরুম পল্লী’ নামে রাঙ্গামাটি শহরে একটি মাশরুম উৎপাদন ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। সেখানে ৩০ চাষি মাশরুম চাষে নিয়োজিত। চলতি বছর এ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি মাশরুম উপকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মাশরুম বীজ স্পন বিক্রি করে বর্তমানে প্রায় সোয়া চার লাখ টাকা রাজস্ব জমা রয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈকিতভাবে সাফল্য অর্জনে রাঙ্গামাটিতে মাশরুম চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে।          

গবেষকরা জানান, মাশরুম একটি সুস্বাদু ও সাধারণ শাকসবজির মতই খাবার। মাশরুমে বিভিন্ন রোগের প্রচুর প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এইডসসহ মারাত্মক রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ ক্ষমতা মাশরুমে আছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে শীতাগে, ইমুজি, সিমাজি, পিএসসি, এইচকে-৫১, পিও-২, বাটন, মিল্কী, স্ট্র, ঋষি, পপ, গোল্ডেন ওয়েস্টার, পিসিওয়াইএসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম চাষ হচ্ছে।

এমজেড/পিআর