রাজশাহীতে আম রফতানি ১ শতাংশের নিচে
বাছাই কড়াকড়ির কারণে এ পর্যন্ত রফতানি হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলের মাত্র ২৩ মেট্রিকটন আম। যা উৎপাদিত রফতানিযোগ্য আমের এক শতাংশেরও নিচে। গত বছর শুধু রাজশাহী থেকেই আম রফতানি হয় ৩০ মেট্রিকটন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রফতানি হয় আরও ২০০ মেট্রিকটন।
রফতানিযোগ্য আম চাষিরা বলছেন, এ বছর রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন। এখনও গাছে ঝুলছে এক কোটি রফতানিযোগ্য আম। তা সত্ত্বেও গত ৩০ জুন বন্ধ হয়ে গেছে আম রফতানি। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে এ অঞ্চলের আম চাষিদের।
আম রফতানি নিয়ন্ত্রণ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং। সেখানকার কর্মকর্তাদের কারণেই কপাল পুড়ছে এ অঞ্চলের আম চাষিদের। ক্ষতি ঠেকাতে গত ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক বরাবর চিঠি লিখেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা। এতে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে দ্রুত আম রফতানিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয়। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন চাষিরা।
চাষিদের হয়ে ওই চিঠিতে সাক্ষর করেন রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক।
আম চাষিদের ভাষ্য, ২০১৫ সাল থেকে স্বাস্থ্যসম্মত ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৬ সালেও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়। সেই বার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ফ্রুটব্যাগিং এ উৎপাদিত আম রফতানি হয়েছে।
লাভবান হওয়ায় এ বছর ব্যাপক রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে চাষিরা এগিয়ে আসেন। চাষিদের সংগঠিত করে গড়ে তোলা হয় রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটি। কেবল কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ এবছর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৬ হাজার মেট্রিকটন আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আর এ জন্য ফ্রুটব্যাগিং করা হয় প্রায় দুই কোটি আম।
তাদের অভিযোগ, ১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ৩১ মেট্রিকটন নন ব্যাগিং আম রফতানি করে উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং। ওই সময় ফ্রুটব্যাগিং এ উৎপাদিত মেহেরপুরের আম রফতানিকারকরা নিয়ে গেলে ৭০ শতাংশই বাদ দেয়া হয়।
রাজশাহী থেকে আম রফতানির কথা ছিলো ২ মে। কিন্তু ১১ জুন রফতানিকারকরা রাজশাহী থেকে ১০ হাজার কেজি আম নেন উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংএ। সেখানে দু হাজার ৮৩৬ কেজি রেখে বাকি আম বাদ দিয়ে দেয়া হয়।
গত ২৩ জুন পর্যন্ত রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের সবমিলিয়ে ২৩ মেট্রিকটন আম বিদেশে রফতানি হয়েছে। যা এ অঞ্চলে উৎপাদিত রফতানিযোগ্য আমের এক শতাংশের কম। সর্বশেষ ৩০ জুন আম রফতানি বন্ধ করে দেয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং। এতে গাছে রফতানিযোগ্য এক কোটি আম নিয়ে বেকায়দায় চাষিরা।
কয়েকজন আম চাষি জানিয়েছেন, নিরাপদ বালাইমুক্ত আম উৎপাদনে চাষিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়া আম চাষি, রফতানিকারক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তারা মিলে সভা-সেমিনার করেছেন। তাতে অংশ নেন উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর শীর্ষ কর্মকর্তারাও।
এসব সভায় নিরাপদ বালাইমুক্ত আম উৎপাদনে চাষিদের ফ্রুটব্যগিং প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। অধিক লাভের আশায় আম উৎপাদন করেছেন চাষির। রফতানিতে ব্যর্থ হয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে নামিয়ে আমের নায্য দাম না পাচ্ছেন না। এতে সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ বছর আম রফতানিতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলেও দাবি করেন চাষিরা।
রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক অভিযোগ করেন, এ বছর সাতক্ষীরা থেকে আগে ভাগেই নন ব্যাাগিং আম রফতানি হয়েছে। অথচ তারা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিএপি (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করেও রফতানি হচ্ছে না। কেবল ফ্রুটব্যাগিং এ উৎপাদিত আম রফতানিতে সমস্যা দেখাচ্ছেন উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর কর্মকর্তারা। এখনও বাগানে ফজলি ও আশ্বিনা আম আছে। এগুলোই এখন তাদের শেষ ভরসা।
এ আম চাষির ভাষ্য, ফ্রুটব্যাগে আম উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমে এসেছে প্রায় ২০ শতাংশ। মাছি, পোকা বা ফ্রুট ফ্লাইয়ের আক্রমণের প্রশ্নই ওঠেনা। আমের গায়ে কোনো দাগ থাকেনা, দেখতেও হয় আকর্ষণীয়। অথচ বাছাইয়ের নামে বাদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে অধিকাংশ আম। কীটনাশক ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা এবং চাষিদের ফ্রুটব্যগিং এ নিরুৎসাহিত করতেই উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কর্মকর্তারা এ কাণ্ড ঘটাচ্ছেন।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর হুদা বলেন, ২৮ মে থেকে ক্ষীরশাপাত রফতানির কথা ছিলো। এছাড়া ৭ থেকে ১০ জুনের মধ্যে ল্যাংড়া ও ২০ জুন থেকে ফজলি আম রফতানির কথা। কিন্তু এ বছর রফতানিকারকদের কাঙ্খিত সাড়া মেলেনি। কয়েক বছর ধরেই তারা জিএপি (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) পদ্ধতিতে আম উৎপাদন সম্প্রসারণে কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন, তারা জেনেছেন, কিছু রফতানিকারক উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এ আম নিয়ে যাচ্ছেন। সেখান থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে অর্ধেকের বেশি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রফতানিকারকরা। এর রেশ গিয়ে পড়ছে চাষিদের উপর। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়বে আসছে মৌসুমে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে। তবে নিশ্চয়তা পেলে চাষিরা আরও বেশি রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে সক্ষম বলেও জানান তিনি।
কীটনাশক ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং চাষিদের ফ্রুটব্যগিং এ নিরুৎসাহিত করার অভিযোগ অস্বীকার করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর উপপরিচালক (রফতানি) কৃষিবিদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন খান।
তিনি বলেন, তারা নন, ফ্রুটব্যাগ বিক্রেতারাই চাষিদের রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এনিয়ে চাষিদের সঙ্গে কৃষি বিভাগের কোনো চুক্তিও নেই। আম চাষিদের ক্ষতির দায়ও তাদের নয়।
অন্যদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসিন বলেন, সাতক্ষীরাতে ফ্রুটব্যাগ ছাড়াই রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সেখানকার ৩০ মেট্রিকটন ইউরোপে রফতানি করা হয়। আরও অন্তত ২০০ মেট্রিকটন প্রস্তুত ছিলো। এর মাঝেই ৩০ জুন আম না নেয়ার কথা জানিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ফ্রুটব্যাগে উৎপাদিত আম রফতানিতে কড়াকটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাতক্ষীরার পরপরই মেহেরপুর ও রাজশাহী থেকে ফ্রুটব্যাগিং এ উৎপাদিত করা হয়েছিলো। এসব আমে পোকাসহ নানান সমস্যা থাকায় তিনটি রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। এরপর থেকেই আম বাছাইয়ে কড়াকটি শুরু করেন তারা। তারা কেবল আমের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করছেন। আম রফতানিতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল বৈষম্যের শিকার হয়নি বলেও দাবি করেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মৌসুমজুড়েই আম রফতানি চলবে বলে জানান তিনি।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসেবে, গত ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছর এ অঞ্চলের ৫৮ হাজার ৯২৪ হেক্টর আম বাগানে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৮ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়েছে। এ বছরও কিছুটা বেড়েছে। ফলে উৎপাদনও বাড়বে বলে ধরে নিচ্ছে কৃষি দপ্তর। এ বছর রাজশাহীর ১০০ চাষি ১০ লাখ আম ফ্রুটব্যাগিং করেন। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৯১ চাষি ফ্রুটব্যাগিং করেন ৩ কোটি আম। ব্যাগিং করা হয় ক্ষিরশাপাত, ফজলি ও আশ্বিনা আম।
এমএএস/পিআর