হঠাৎ এত গোখরা কেন
রাজশাহী অঞ্চলে বেড়েছে বিষধর সাপের উপদ্রপ। সম্প্রতি জেলার তানোর এবং নগরীর বুধপাড়ায় মারা পড়েছে ১৫২টি গোখরা সাপ। এগুলোর সবগুলোই বাচ্চা। মাটির পুরনো বাড়িতে ইঁদুরের গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল সাপগুলো। আতঙ্কিত গৃহকর্তারা সবগুলোই পিটিয়ে মেরেছেন।
এ খবর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে পরিবেশের জন্য সাপের আধিক্য আশির্বাদ বলে মনে করছেন প্রাণী ও পরিবেশবিদরা। সাপ না মেরে সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
এদিকে কেবল সাপের উপদ্রপ নয়, এ অঞ্চলে সাপ দংশনের খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিনই। গড়ে দুজন করে সাপেকাটা রোগী আসছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। সর্বশেষ শনিবার ভর্তি হয়েছেন দুজন রোগী।
রামেক হাসাপাতালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সাত দিনে হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছে ৯ জন। এর মধ্যে গত ১ জুলাই মারা যান সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নূরুল ইসলামের মেয়ে ববিতা খাতুন (১৫)। এর তিন দিন পর মৃত্যু হয় রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার করিশা এলাকার হাসেম আলীর স্ত্রী সাদিয়া খাতুনের (৩০)।
এর আগে গত ১ জুন মারা যান নাটোরের শ্যামপুরের আব্দুল আলীমের ছেলে শামীম হোসেন (২৫)। ১৫ জুন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ইমান আলীর ছেলে আয়ের আলীর (৪৫) মৃত্যু হয়। গত ১২ মে মারা যান জেলার পবা উপজেলার লালচানের ছেলে ইসাহাক আলী (৩০)। এর পাঁচদিন পর মারা গেছেন তানোরের মজিবুর রহমানের ছেলে আমিনুল ইসলাম (৪৮)। এ বছরের ১৭ জানুয়ারি সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় জেলার চারঘাটের ভাদু সরকারের স্ত্রী নেহেরা বেগমের (৪৫)।
অধিকাংশ রোগী বিষধর গোখরা সাপের কামড়ে হাসপাতালে আসছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, গোখরার বিষ সরাসরি স্নায়ুকে আক্রমণ করে। ফলে ফুসফুস অবশ এবং হৃৎপিন্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত। ওঝার কাছে না গিয়ে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।
সাপেকাটা রোগীদের চিকিৎসায় রাজশাহী মেডিকেলে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালে ৩৩০টি এন্টি স্নেক ভেনম ইনজেকশন মজুদ রয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় সাপেকাটা রোগীর চাপ বাড়বে। এ জন্য নতুন চাহিদা দেবেন শিগগিরই। তবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এন্টি স্নেক ভেনম সরবরাহ ছিল না বলেও জানান পরিচালক।
জানা গেছে, এ অঞ্চলে পাওয়া গোখরা উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ। এটি গোমা, খইয়া বা খড়মপায়া গোখরা বলেও পরিচিত। এর ইংরেজি নাম ইণ্ডিয়ান কোব্রা। বৈজ্ঞানিক নাম নাজা নাজা (naja naja)। একটির ফণায় চশমার মতো দুটি চক্র থাকে। দেড় মিটার দৈর্ঘ্যের গোখরা নিশাচর। এরা মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে, চাষের জমি ও বনাঞ্চলে বাস করে। বিশেষ করে ইঁদুর খেতে গৃহস্থের বাড়িতে যায় গোখরা। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে ছোট পাখি, ব্যাঙসহ অন্যান্য উভচর জীব।
দেখতে প্রায় একই রকম গোখরা গোষ্ঠীর অন্য সাপগুলো হলো- কেউটে, শঙ্খচূড়, স্পিটিং কোবরা। এরাও অত্যন্ত বিষধর। বিরক্ত না করলে এরা সাধারণত: মানুষকে আক্রমণ করে না। গোখরা ছাড়াও সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলে পাওয়া গেছে রাসেল ভাইপার। মারাত্মক বিষধর এ সাপ রয়েছে বিপন্ন প্রাণির তালিকায়। বর্ষায় গোখরার উপদ্রব বাড়লেও প্রায় বছর জুড়েই উপদ্রপ থাকে রাসেল ভাইপারের।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, রাজশাহীর যে দুই বাড়িতে গোখরা পাওয়া গেছে সেগুলো বেশ পুরনো মাটির বাড়ি। অন্ধকার ও মানুষের চলাফেলা নেই এমন জায়গায় ইঁদুরের গর্তে বাসা বেধে বাচ্চা ফুটিয়েছে এরা। আবাসস্থল হারিয়ে গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল গোখরা। কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে সাপগুলো মেরে ফেলা হয়েছে। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রে সাপের ভূমিকা ব্যাপক উল্লেখ করে এ অঞ্চলে গোখরার উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি।
সামাজিক বন বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন জানান, গত পাঁচ বছর ধরে তারা এ অঞ্চলে বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেছেন। একসঙ্গে এতোগুলো গোখরা পাওয়া এ কার্যক্রমের সফলতা। তবে সম্প্রতি প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে গেছে এ কাজ। বিশেষজ্ঞ না থাকায় বন্ধ বণ্যপ্রাণী সুরক্ষাও। তবে পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা কার্যক্রম চলছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, রাজশাহীতে দুই দফা ১৫২টি গোখরা সাপ মেরে ফেলা হয়েছে কেবল আতঙ্ক থেকেই। আগে ভাগে খবর পেলে সেগুলো উদ্ধার করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা যেতো। তবে ওই দুই বাড়িতে এখনো অন্তত চারটি পূর্ণ বয়স্ক সাপ রয়েছে। ফলে এখনো আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি পরিবার দুটির। আইনে বণ্যপ্রাণী হত্যা দণ্ডনীয় হলেও ওই পরিবার দুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত ৬ জুলাই সন্ধ্যার পর জেলার তানোর পৌর এলাকার ভদ্রখণ্ড মহল্লার কৃষক আক্কাছ আলীর রান্না ঘর থেকে একে একে বেরিয়ে আসে ১২৫টি গোখরা সাপ। এর আগের রাতে রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া মহল্লায় গৃহকর্তা মাজদার আলীর বাড়িতে পাওয়া যায় ২৭টি গোখরা। স্থানীয়দের সহায়তায় তখনই মেরে ফেলা হয় সাপগুলোকে। এ ঘটনার পর আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন কৃষক আক্কাছ আলী। তবে আতঙ্ক নিয়েই নিজ বাড়িতে বাস করছেন মাজদার আলী।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর/এমএস