অভাবের তাড়নায় একবেলা খেয়ে রোজা রাখছেন মা-মেয়ে
দুঃখ, কষ্ট আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজে ও সন্তানদের বাঁচানোর লড়াই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। শত কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকার আনন্দে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিচ্ছেন রহিমারাও বাঁচতে জানে।
শত কষ্টে জীবনের কাছে হার মানে না তারা। কিন্তু অভাব তাদের পিছু ছাড়ে না। তাদের মনে আনন্দ, মুখে হাসি কিছুই নেই। সমাজের উৎসব-আনন্দ তাদের স্পর্শ করছে না। তাদের জীবনে আসা প্রতিটি দিন যেন একই রকম। রমজান মাস, ঈদ, উৎসব সব দিনই তাদের কাছে এক।
‘রহিমা বেওয়া (৬৫)। দুই সন্তানের জননী। গত চার বছর আগে স্বামী খাতিবর অসুস্থজনিত কারণে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসারের হাল ধরেন রহিমা। মানুষের বাড়িতে, অনেক সময় মানুষের কৃষি খামারে কাজ করে যা উপার্জন করেন তা দিয়েই চলে সংসার। ছেলে বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদাভাবে থাকছে। একমাত্র প্রতিবন্ধী মেয়ে বেগমকে (২৮) নিয়ে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে জীবন চালান তারা।
রমজানে কী দিয়ে ইফতার করেন এমন প্রশ্ন করতেই আক্ষেপ প্রকাশ করে রহিমা বলেন, গরিবের আবার ইফতার! নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তিনবেলা খাবার কেনাই কষ্টকর! তাই একবেলা খেয়ে মা-মেয়ে রোজা রাখি। ভালো ইফতারি কেনার সাধ্য তো আমার কখনও হয়নি। টেস্টি স্যালাইন পান করেই ইফতার করছি এবার। বড়লোকদের মতো বাহারি ইফতার কখনও খাওয়া হয় না আমাদের মতো গরিব পরিবারগুলোর।
এভাবেই কথাগুলো বললেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা রায়পুর ইউনিয়নের বাকসিঁড়ি এলাকায় মৃত খাতিবর রহমানের স্ত্রী রহিমা। রমজানের শুরু থেকে একবেলা খেয়ে না খেয়ে রোজা রাখছেন মা-মেয়ে।
রহিমা বলেন, ‘জীবন মানে যুদ্ধ’ সেটি বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি। কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ হচ্ছে না। প্রতিদিনই দুই মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করছি। কিন্তু অভাব তো পিছু ছাড়ছে না। যেদিন অসুস্থ থাকি মা ও প্রতিবন্ধী মেয়ে নিয়ে অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটাতে হয়। মনে করেছিলাম ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কপালটা খারাপ সে বিয়ের পর বৌকে নিয়ে পর হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু অভাবের কারণে জামাই বেশিদিন রাখেনি। এখন মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টের মাঝে দিন পার করছি। রোজা রাখছি মা-মেয়ে সাহরিতে দু মুঠো ভাত খেয়ে। পরদিন কাজ করে যা উপার্জন করি তা দিয়ে আবার বাজার থেকে চাল কিনে আনি। সারাদিন ক্লান্তির পর টেস্টি স্যালাইন দিয়েই ইফতার করি। কখনও মেয়েটিকে ঈদে কাপড়-চোপড় কিনে দিতে পারিনি।
শুধু রহিমার জীবনে রমজানে কষ্ট করে টেস্টি স্যালাইন দিয়ে ইফতার করেন তা নয়। ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের শুধু রমজান নয়, নিত্যদিনের ঘটনা এটি।
ঠাকুরগাঁও জেলায় ৮০ ভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচ বাস করে। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় ঈদ বা কোনো উৎসবই প্রবাহিত লক্ষ্য করা যায় না। ফলে সমাজের একটা বড় অংশই ঈদ বিনোদনের বাইরে থেকে যায়।
ঠাকুরগাঁওয়ে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিতের কারণে কখনও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে রমজান মাস বা ঈদ উৎসব বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসতে পারে না। অর্থের অভাবে নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারে না খেটে খাওয়া নানা পেশার মানুষ। সামান্য সেমাই-চিনি কিনতে গিয়েই তাকিয়ে থাকতে হয়েছে স্থানীয় মুদি দোকানদারদের মুখের দিকে তার করুণা লাভের প্রত্যাশায়।
মো. রবিউল এহসান রিপন/এএম/আরআইপি