কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে বিপাকে সরকার
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি বাংলাদেশের কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। যে উদ্দেশ্য ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রায় ছয় দশক আগে হ্রদটির সৃষ্টি তা এখন ক্রমে আপদে পরিণত হতে চলেছে। সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত একবারও ড্রেজিং হয়নি কাপ্তাই হ্রদের। ফলে তলদেশ ভরাট হওয়ায় দিন দিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে হ্রদটি। এতে সৃষ্টি করেছে বিদ্যুৎ ও মৎস্য উৎপাদন এবং নৌপরিবহন সঙ্কট। যে কারণে রীতিমতো ভীষণ উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার এখনো উদাসীন। এ নিয়ে মুখে বললেও বাস্তবে সমাধানের কোনো উপায় খুঁজে বের করছে না সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে সরকারের দুটি উপায় আছে। এ দুটির মধ্যে বেছে নিতে হবে যেকোন একটি উপায়। উপায় দুটি হল- হয় কাপ্তাই বাধ ভেঙে হ্রদের সব পানি ছেড়ে দিতে হবে। আর না হয় হ্রদের পানি ধরে রাখতে অবশ্যই লেকটি ড্রেজিং করাতে হবে। কিন্তু দুটোতেই মহাবিপদ। বাধ ভেঙে পানি ছাড়লে মহাবিপদ।
সেটি হল ভাটি এলাকার সমূহ মহাবিপর্যয়। এতে প্লাবনে তলিয়ে যাবে বহু জমি-জমা, বাড়িঘর ও স্থাপনা। এক্ষেত্রে কাপ্তাই বাধ ঘিরে ঘটতে পারে আরেক মানবিক বিপর্যয়। বাধ নির্মাণের ফলে তলিয়ে গেছে অর্ধ লক্ষাধিক চাষযোগ্য জমি এবং উদ্বাস্তু হতে হয়েছে লক্ষাধিক পরিবারকে। এছাড়া কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। হ্রদের পানি শুকিয়ে ডাঙায় পরিণত হবে বিস্তীর্ণ জলাশয়। ফলে একেবারে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা।
কাজেই সমূহ আপদ সরিয়ে বেছে নিতে হবে পরের উপায়টি। সেটি হল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ। এটি ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই সরকারের। এজন্য প্রয়োজন মহাপ্রকল্প। কারণ, হ্রদটি ড্রেজিং করতে হলে দরকার হবে হাজার হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও পাহাড়ি এলাকায় যে হারে পাহাড় কাটা চলে এবং বনজসম্পদ ধ্বংস করা হয়ে থাকে তা চলতে থাকলে ড্রেজিং করা হলেও অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আবার রাতারাতি হ্রদ ভরাট হয়ে যাবে। এতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও তা জলে ভেসে যাবে। কাজেই হ্রদটি ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিতে হলে পাহাড় কাটা ও অবাধ বনজসম্পদ ধ্বংস বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাহাড়ে জুম চাষের বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়নেও জনসচেতনতার পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব সমূহ আপদ সরিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে কাপ্তাই হ্রদ ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মহাপ্রকল্প।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে খরস্রোতা কর্ণফুলি নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাধ। এতে সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও গড়ে ওঠে রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সঙ্গে সাত উপজেলার নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্য উৎপাদন, জলে ভাসা জমিতে বোরো চাষাবাদ এবং নৌভ্রমণ ভিত্তিক পর্যটনসহ বহুমুখী সুবিধা ও সম্ভাবনা। অপরদিকে কাপ্তাই বাধের ফলে জলমগ্ন হয় ৫৪ হাজার একর ধানি জমি। উদ্বাস্তু হয়েছেন লক্ষাধিক পরিবারের মানুষ।
এদিকে সৃষ্টির পর একবারও ড্রেজিং না হওয়ায় পলি জমতে জমতে ভরাট হয়ে গেছে এ কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ। ফলে ক্রমশ হ্রদের গভীরতা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে হ্রদটি। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সঙ্কট। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে হ্রদের পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় নৌচলাচল ও মৎস্য প্রজনন দারুণ ব্যহত হচ্ছে। সরকার হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কথা বললেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। এতে বিপাকে হ্রদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কমিটি।
এ ব্যাপারে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন বলেন, কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিং ছাড়া সৃষ্ট সঙ্কট দূর করা যাবে না। কিন্তু এতে প্রয়োজন বিপুল অর্থ। তবে ড্রেজিং করা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ পাহাড় কাটা ও অবাধ বনজসম্পদ ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। জুমচাষে যে মাটি খনন করা হয় তার বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে তা বন্ধেও এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে হ্রদ ড্রেজিং করা হলেও আবার রাতারাতি ভরাট হয়ে যাবে। জুম চাষের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মাটি কাটা বন্ধ করে জুমের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন ও মিশ্র ফসল চাষে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এজন্য কৃষি বিভাগ ও অধিদফতরের মাধ্যমে চাষিদের সহায়তা দেয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, কাপ্তাই হ্রদ ভরাট হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। হ্রদে মাছ উৎপাদন কমে যচ্ছে। দেখা দিয়েছে নৌপরিবহন সঙ্কট। এসব সঙ্কট দূর করতে একমাত্র উপায় হ্রদের ড্রেজিং। তবে ড্রেজিং করতে হলে আগে করণীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কাপ্তাই হ্রদের সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক করে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। এ কমিটির সভাও অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির বিভিন্ন সভার প্রস্তাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কাপ্তাই হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায়। এটি অনুমোদন হলে হ্রদের সম্পূর্ণ এলাকা জরিপ করে কোথায় কোথায় ড্রেজিং করতে হবে সেগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন শুরু করা যাবে।
সূত্রের তথ্য মতে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে পাঁচটি পয়েন্টে কাপ্তাই হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ওই পাঁচটি পয়েন্টে জরুরি ভিত্তিতে কাপ্তাই লেক ক্যাপিটাল ড্রেজিং দরকার। প্রস্তাবিত পয়েন্টগুলো হচ্ছে, রাঙ্গামাটি থেকে কাপ্তাই, মারিশ্যা (মাইনী ও কাচালং খাল), মহালছড়ি (চেঙ্গী খাল), ছোট হরিণা এবং কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের পর বছর পাহাড়ি ঢলে নামা পলি জমে হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া হ্রদের উভয় তীরে অব্যাহত ভাঙনসহ প্রতিদিন শত শত মেট্রিকটন বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে হ্রদে। এসব কারণে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে হ্রদটি। এ অবস্থায় কাপ্তাই হ্রদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে হ্রদে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ উভয় তীরে সড়ক নির্মাণের জন্য সরকার গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।
সুশীল চাকমা/এমজেড/আরআই