ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর চাঁপাই অংশে পদ্মা এখন মৃত
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশে পদ্মা নদী এখন মৃত প্রায়। নদী নব্যতা হারানোয় বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার উপর।
নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। মহানন্দা, পগলাসহ আশপাশের কয়েকটি নদী এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের মাছ, অপরদিকে পদ্মা নদীর প্রাণ ঘড়িয়াল ও শুশুক এখন বিলুপ্ত প্রায়। বারবার পদ্মা নদীর গতিধারা পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে ওই এলাকার মানুষ, হারাচ্ছে ফসলি জমি।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ-আন্দোলন বা পানি বন্টন চুক্তির পরেও এর কোনো সুরাহা হয়নি।
ভারতের উত্তরা খন্ড রাজ্যের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে গঙ্গা নদীর উদ্ভব। সেখান থেকে ভারতের বিভিন্নস্থানে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাংখা পয়েন্টে প্রবেশ করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের কামারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে এ নদীতে পানি থাকেনা। বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিচু এলাকা প্লাবিত হয় এবং নদী তীর প্রতিবছরই ভাঙে। এ ভাঙনের কবলে পড়ে তাদের বসত বাড়িসহ ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ায় এখন বাইরে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চরপাঁকা গ্রামের শামসুল ইসলাম বলেন, গত দুই দশকে পদ্মার গতিপথ বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হওয়ার কারণে তিনবার তার বাড়ি ভেঙেছে। বারবার বাড়ি ভাঙার কারণে এখন প্রায় তিনি নিঃস্ব। শুষ্ক মৌসুমেও এ এলাকায় নদীর পাড় ভাঙছে। তাই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে স্থানীয়দের।
পাউবো সূত্র জানায়, শুষ্ক মৌসুমে কম পানি এবং বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশের উপরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ায় এ অঞ্চলে প্রতিবছর নদী ভাঙছে। নদী ভাঙনের কারণে মানুষ গৃহহারা হচ্ছে এবং হারাচ্ছে ফসলি জমি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ শাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, বাংলাদেশের পাংখা পয়েন্ট থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উজানে ভারত ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে।
মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এবং একতরফাভাবে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় পদ্মা নদী এখন মৃত প্রায়। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কম থাকায় নদীটি মূল স্রোতধারা হারিয়ে এখন ৩টি পৃথক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পদ্মার মূল স্রোতধারা প্রতি বছর পরিবর্তিত হচ্ছে।
অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অকাল বন্যা এবং নদী ভাঙন। এরফলে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পদ্মা পাড়ের মানুষ এবং ফসলি জমি।
শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতা-অসময়ে বেশি পানি প্রবাহের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ভারত কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করার কারণে পদ্মার নাব্যতা হারিয়ে জেগে উঠছে চর।
এ এলাকায় পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’ এর কো-অর্ডিনেটর রবিউল হাসান ডলার জানান, পদ্মা পৃথিবীর বৃহৎ চারটি নদীর অন্যতম। একটি নদী শুধু পানি সরবরাহ করেনা-পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার উপরে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
পদ্মা নাব্যতা হারানোয় দেশি জাতের মাছ, শুশুক, ঘড়িয়ালসহ নানা মেরুদণ্ডি ও অ-মেরুদণ্ডি প্রাণি এবং জলজ উদ্ভিদের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। শুশুক ও ঘড়িয়াল এখন বিলুপ্ত প্রায়।
এভাবে চলতে থাকলে এ নদী নিকট ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। মানুষের জীবন জীবিকা এবং পরিবেশের উপর এখন বিরূপ প্রভাব পড়ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্য এবং এ অঞ্চলে পড়বে নানা রকম বিরূপ প্রভাব।
এ অবস্থায় পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার তা করতে ব্যর্থ হলে শুধু পদ্মা পাড়ের মানুষই নয়-বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পড়বে বিরূপ প্রভাব।
তাই ‘সেভ দ্য নেচার’ মনে করে, পানির ন্যায্যতা নিশ্চিত এবং প্রয়োজনে ড্রেজিং ও দুই পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা নিশ্চিতকরণ জরুরী।
ফারাক্কা মিছিলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার মিডিয়া সেলের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যম কর্মী ডিএম তালেবুন নবী জানান, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানী কানসাট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তার এ ডাকে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেন।
সেই সময় মহনন্দা নদীর উপর কোনো সেতু ছিলনা, স্থানীয়রা নৌকা দিয়ে সেতু বানিয়ে মিছিল নিয়ে কানসাট অভিমুখে রওয়ানা হয়। প্রচণ্ড খরাকে উপেক্ষা করে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে মানুষ ফুঁসে উঠে। রাস্তার আশপাশের মানুষ ওই মিছিলের লোকজনকে পানি, খাবারসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।
পরে কানসাট স্কুল মাঠে এক জনসভায় মওলানা ভাষানী বলেন, ফারাক্কা প্রত্যাহার করে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা ভাটির দেশে নিশ্চিত না করলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।
এমএএস/বিএ