যেভাবে শেষ হলো ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’
শুরুটা বুধবার। শনিবার বিকেলে সমাপ্তি। অপারেশন স্ট্রাইক আউট। কুমিল্লা শহরের অদূরে কোটবাড়ি সংলগ্ন বাগমারা (গন্ধমতি) গ্রামের একটি বাড়ি ঘিরে তিনদিন ধরে এলাকায় ছিল শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।
ওই এলাকার একটি তিনতলা বাড়ির নিচের একটি কক্ষে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পরিচালিত ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ অভিযান শেষ হয়েছে শনিবার বিকেলে।
এর আগে সেখানে জঙ্গি অবস্থানের সন্দেহে তলব করা হয় কাউন্টার টেরোরিজম, বোমা বিশেষজ্ঞ দল ও সিআইডির ক্রাইম সিন।
নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় পুরো এলাকা। কিন্তু ওই আস্তানায় মিলেনি কোনো জঙ্গির সন্ধান। শুক্র ও শনিবার অভিযানে পাওয়া গেছে ১০ কেজি করে ওজনের তিনটি শক্তিশালী বোমা, ছয়টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট। এরপর শনিবার দিনভর বোমা বিশেষজ্ঞ দল এসব বোমা নিষ্ক্রিয় করে। পাশাপাশি ওই এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা, যা আজ সন্ধ্যা ৬টায় তুলে নেয়া হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন।
এ বিষয়ে রাতেই জেলার সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলার কথা রয়েছে।
যে কারণে ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’:
শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম অভিযানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, গত ১৫ মার্চ মিরসরাইয়ে দুই জঙ্গিকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। ফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদনের সঙ্গে আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মেলানো হয়।
এর ভিত্তিতে গত ২৮ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম থেকে এক জঙ্গিকে আটক করা হয়। সে (জঙ্গি) কুমিল্লার গন্ধমতির ওই আস্তানায় আনাস ওরফে আনিস এবং রনি নামের দুই জঙ্গি রয়েছে বলে জানায়।
তিনি আরও বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে বাড়িটি ঘেরাও করার আগেই জঙ্গিরা পালিয়ে যায়। ওদের (জঙ্গি) নিয়ম অনুযায়ী, একজন বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে বাসায় ফিরতে দেরি হলে আরেকজনও বেরিয়ে যায়। দুই জঙ্গি গত ১ মার্চ বাসাটি ভাড়া নেয়ার আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বাসা ভাড়া নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা দুজন পাঁচ মাস আগে নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। দুই জঙ্গির ছবিও পুলিশের কাছে আছে।
অভিযান শুরু ও সমাপ্তি :
চট্টগ্রামে আটক এক জঙ্গির দেয়া তথ্য অনুযায়ী ও তার দেখানোমতে গন্ধমতি গ্রামের একটি কবরস্থানের পাশের দেলোয়ার হোসেনের নির্মাণাধীন তিনতলা বাড়ির জঙ্গি আস্তানা গত বুধবার বিকাল ৪টার দিকে ঘেরাও করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা আশপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জালের মতো সতর্ক বলয় গড়ে তোলে।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কারণে বুধ ও বৃহস্পতিবার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়নি। গত শুক্রবার ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই বাড়িতে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালায় পুলিশ, র্যাব, সোয়াট, কাউন্টার টেরোরিজম দলসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত অভিযানিক দল। অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’।
ওই বাড়ির নিচতলায় জঙ্গিদের ভাড়া করা কক্ষে জঙ্গি পাওয়া না গেলেও তাদের (জঙ্গি) ব্যবহৃত একটি ট্রলি ব্যাগের ভেতর তিনটি বোমা, ৬টি হ্যান্ড গ্রেনেড, দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট পাওয়া যায়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বাড়িটি ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে পড়ায় অভিযান স্থগিত করা হয়।
গতকাল শনিবার বোমা নিষ্ক্রিয়করণ অভিযানের নেতৃত্ব দেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন। এসময় বোমা নিষ্ক্রিয়করণ বিশেষজ্ঞ দল, সিআইডির ক্রাইম সিন, জেলা পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছিলেন।
দ্বিতীয় দফায় অভিযান ও বোমা নিষ্ক্রিয় করার পর সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সম্মেলন কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন জানান, জঙ্গিদের অবস্থান করা আস্তানায় তল্লাশি করে ১০ কেজি করে ওজনের শক্তিশালী তিনটি বোমা, ৬টি হ্যান্ডগ্রেনেড, দুইটি সুইসাইডাল ভেস্ট পাওয়া গেছে।
২২ সদস্যের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ বিশেষজ্ঞ দল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা নাগাদ এগুলো পর্যায়ক্রমে নিষ্ক্রিয় করেছে। দুপুরে একটি বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এসময় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিভিয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ওই জঙ্গিদের কক্ষ থেকেেএক হাজার স্প্লিুন্টার ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।
তিনি আরও জানান, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ওই এলাকায় জারি করা ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হয়েছে। এসময় কুমিল্লা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল-মামুন, আবদুল মোমেন, শাখাওয়াত হোসেন, তানভীর সালেহীন ইমন, জেলা ডিবির ওসি এ কে এম মনজুর আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য কোটবাড়ি, সালমানপুর, গন্ধমতিসহ আশপাশের এলাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা ছাত্রাবাসে জঙ্গিদের অবস্থান থাকতে পারে সেই আশঙ্কায় রোববার থেকে ওই এলাকার সন্দেহজনক ছাত্রাবাস ও বাসা-বাড়িতে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা অভিযান চালাবে বলে জানা গেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন।
অন্যদিকে, বোমা-গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় রাতেই সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা দায়ের করার কথা রয়েছে। অভিযান শেষ হওয়ায় এবং ওই এলাকায় জারিকৃত ১৪৪ ধারা তুলে নেয়ার পর স্থানীয় এলাকাবাসী কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। এলাকায় বিচ্ছিন্ন করা গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন পুনঃসংযোগ দেয়া হয়েছে।
কামাল উদ্দিন/এআরএ/পিআর