‘তখনো লাশের পাশে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছিল’
তখনও যুদ্ধ চলছে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে পিছু হটতে শুরু করেছিল পাকহানাদার বাহিনী। কিন্তু তৎকালীন দিনাজপুর জেলার আওতাধীন পঞ্চগড়ের একমাত্র এবং ভারি শিল্প-কারখানা পঞ্চগড় চিনিকলে আশ্রয় নেয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদস্যরা।
’৭১’র ২৯ নভেম্বর ভোরে মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী যৌথভাবে চিনিকল আক্রমণ করে। তখন যুদ্ধ চলে আশপাশের বিভিন্ন এলাকতেও। দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিদের হটানো যাচ্ছিল না।
যুদ্ধ পরিস্থিতি মিত্রবাহিনীর হাই কমান্ডকে অবহিত করা হয়। দুপুর আড়াইটা নাগাদ ভারতীয় একটি হেলিকপ্টার আক্রান্ত এলাকার আকাশ থেকে সিগন্যাল দিতে থাকে।
সিগন্যাল অনুযায়ী মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানিদের ওপর শেল নিক্ষেপ করে। যৌথবাহিনীর মুহুর্মুহু হামলায় পিছু হটতে থাকে পাকহানাদার বাহিনী।
এর মধ্যে পাশের এলাকা ফকিরের হাটে পাকসেনারা একটি শেল নিক্ষেপ করে। এতে মিত্রবাহিনীর ১২ জন ভারতীয় বিএসএফ সদস্য একসঙ্গে শহীদ হন।
কথাগুলো বলছিলেন, পঞ্চগড় সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি ও পঞ্চগড় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মো. সায়খুল ইসলাম।
তখন তার বয়স ১৮ বছর। বাড়ি শহরতলীর মিরগর এলাকায়। স্থানীয় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীও ছিলেন সাইখুল ইসলাম।
দেশের জন্য সংগ্রামে অংশ নিতে পেরে গর্বিত তিনি। গর্বের সঙ্গেই বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তবে ক্ষণে ক্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে যান তিনি। পাকসেনাদের নির্মম নির্যাতনের কথা বলতে বার বার চোখে জল আসছিল। আবেগাপ্লুত হয়েই ফিরে যান পঞ্চগড়ে ’৭১’র সেই দিনগুলোতে।
তার ভাষ্য, ২৯ নভেম্বর বিকেল ৪টা নাগাদ মুক্ত হয় চিনিকল এলাকা। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা চিনিকলের ভেতরে গিয়ে দেখেন গুলিবিদ্ধ দুই পাকিস্তানি সেনার মরদেহ। তখনও মরদেহের পাশে পাকিস্তানি পতাকাই উড়ছিল।
একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর টগবগে যুবক হারুন অর রশিদ দৌড়ে গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়াতে চেষ্টা করেন।
রশিদের বাড়ি সদর উপজেলার কহুরুর হাট এলাকায়। কিন্তু গুলিবিদ্ধ দুইজনের মধ্যে একজন শুয়ে থেকেই রশিদকে লক্ষ্য করে আকশ্মিক ব্রাশ ফায়ার করেন। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ।
তিনি দেখতে সুদর্শন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেশ সাহসী ছিলেন। যৌথবাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ভারতের বিএসএফ কর্মকর্তা মেজর শেরকির খুব কাছের মানুষ ছিলেন রশিদ।
তার শহীদ হওয়ার ঘটনায় ভেঙে পড়েন মেজর শেরকি। পরে তিনি রশিদের মরদেহ নিয়ে যান এবং ভারতের কোটগছ বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে দাফনের ব্যবস্থা করেন। এখনো রশিদের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে ভারতের কোটগছ ক্যাম্পের সামনে।
পঞ্চগড়ে সংগ্রাম পরিষদের হয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীসহ মুক্তিযোদ্ধারা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে পঞ্চগড় চলে আসেন তৎকালীন এমএলএ মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সিরাজুল ইসলাম।
১১ মার্চ রাত ৯টায় বোদা উপজেলার ময়দানদীঘির পাড়ে সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন। সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার এদের মনোনীত করেন।
যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সিরাজুল ইসলাম এদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, কোনক্রমেই যেন কোথাও দাঙ্গা না হয়। ভারত সীমান্তের বিভিন্ন ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি ইপিআর, মুজাহিদ ও আনছার সদস্যদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সিরাজুল ইসলাম।
’৭১’র ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান রিপাবলিকান ডে। সেদিনই পঞ্চগড় থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মরহুম নাজিম উদ্দীন আহাম্মেদ।
২৫ মার্চ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানিদের আক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২৯ মার্চ রাতে পঞ্চগড় ইপিআর কোম্পানি কমান্ডে বিদ্রোহ করেন পূর্ব-পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যরা।
এতে পশ্চিম পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যরা পরাজিত হন। গুলি খেয়ে মারা যান একজন পাঞ্জাবি ইপিআর সদস্য। এ সময় স্থানীয় কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা একত্রিত হতে থাকেন মহান মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
পরে তারা বিহারিসহ ১২ জনকে পঞ্চগড় সদরের ভাবরঙ্গী এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তবে কৌশল করে তাদের মধ্যে বেঁচে যান আব্দুর রশিদ নামে এক বিহারি। তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে গুলি করেন মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সামছুজ্জোহা রবি।
পঞ্চগড়ের আগে পাকসেনাদের হাতে আক্রান্ত হয় পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও। পঞ্চগড়ে পাকসেনারা প্রবেশ করে মূলত ১৭ এপিল। সেদিনই মুজিব নগর সরকার শপথগ্রহণ করে।
পরে মরহুম সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের শেরে বাংলা মোড়ের (বর্তমান সদর থানা) পাকিস্তানিদের অস্ত্রাগার দখলে নেয়।
সেখানেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তারা ঠাকুরগাঁও হয়ে দিনাজপুরের দিকে যেতে থাকেন। বীরগঞ্জের ভাতগাও এলাকায় আকশ্মিক পাকসেনাদের আক্রমণের শিকার হন মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযোদ্ধা সাইখুল ইসলাম জানান, পরে তিনি তার ফুপাতো ভাইয়ের সহযোগিতায় ভারতে যান। সেখানে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেহেরাদুনে সেনা কর্মকর্তা মেজর মালহোত্রা, কর্নেল প্রকাশতু এবং ক্যাপ্টেন তেওয়ারীর কাছে ৩৫ দিনের প্রশিক্ষণ নেন।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু। প্রশিক্ষণ শেষে ১৫ জুলাই ১৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ফিরে আসেন।
তারা কয়েকটি দলে বিভিন্ন হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি মরহুম নাজিম উদ্দীন আহাম্মেদের নেতৃত্বে পঞ্চগড়ের বোদা এবং আটোয়ারী এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত হন মুক্তিযোদ্ধা সাইখুল ইসলামের সহযোদ্ধারা।
তারা আটোয়ারীর ১২ আওলিয়া এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখান থেকে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন ঠাকুরগাওয়ের রঙ্গিয়ানী, বোদার বলরামপুর, আটোয়ারীর কিসমত, নয়নি বুরুজ, ডাঙ্গীপুকুরী এলাকায়।
যুদ্ধকালীন মার্শাল মুনির ও ভারতীয় বিএসএফের আঞ্চলিক কমান্ডার বালা রেড্ডি খবর দেন মিত্র বাহিনীর কথা। ২১ নভেম্বর থেকে মুক্তি বাহিনী ও ভারতের মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
ভারতের ২৯ মাউন্টেন্ড ব্যাটালিয়ন, ৩২ রাজপুত আর্টিলারি এবং ৭৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নসহ মুক্তিযোদ্ধারা ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় চিনিকল শত্রুমুক্ত করেন। এ জন্য ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত দিবস পালন করা হয়।
সফিকুল আলম/এএম/এমএস