চাঁপাইনবাবগঞ্জে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এখনই সচেতন না হলে এ এলাকায় সুপিয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ও পানি সংকটপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় দ্বিতীয় ইউনিয়ন হিসেবে রাখা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডব্লিউআরএম) জরিপে ঝিলিম ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ হিসাবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষের (বিএমডিএ) তালিকায় বাধাইড় ইউনিয়কে প্রথম ও ঝিলিম ইউনিয়নকে দ্বিতীয় রাখা হয়েছে।
সংস্থাটির রাজশাহী অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, এক যুগ আগেও উল্লেখিত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেতো। বর্তমানে তা ১৬০ ফুট বা তারও নিচে না গেলে পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে অবস্থান করছে।
ঝিলিম ইউনিয়নের জামতলার নওহাটা মৌজার বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ অপরেটর কাবা আলী বলেন, তার গভীর নলকূপের আওতায় গত ছয় থেকে সাত বছর আগেও যে পরিমাণ পানি উঠতো তাতে একশ ৫০ বিঘার বেশি জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করা গেছে খুব সহজে। কিন্ত বর্তমানে কম পানি উঠায় চাষাবাদ নেমে এসেছে ৩০ থেকে ৪০ বিঘাতে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা জোনের সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ঝিলিম ইউনিয়নে বিএমডিএর ১১৩টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় দুই হাজার ৭০০ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ দেয়া হয়ে থাকে। ঝিলিম ইউনিয়ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সবচেয়ে উঁচু ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত। এ ইউনিয়নে বিএমডিএ’র গভীর নলকূপের পাশাপাশি ওই এলাকার শিল্প কারখানায় ব্যবহারের জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে মিঠাপানি উত্তোলন করছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানি দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবয়েল ও কূয়া পানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, বিএমডিএ’র গভীর নলকূপগুলো গত ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ভূগভর্স্থ ১৪০ থেকে ১৫০ ফিট নিচে পানির লিয়ার পাওয়াই সে সময় বসানো হয়েছিল কিন্তু শিল্পকারখানাগুলো তাদের গভীর নলকূপ বসাচ্ছে ২০০ ফিটেরও নিচে। এরফলে ভূগভর্স্থ পানি দ্রুত টেনে নেয়ায় বিএমডিএ’র নলকূপগুলো পানি সংকটে ভুগছে বেশি।
প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ঝিলিম ইউনিয়ন এলাকায় ২০১৫ সালে পানির স্তর পরিমাপ কূপ বসানো হয়েছিল। তখন পানির স্তর ছিল ১০১ ফিট। মাত্র দুই বছরে ২০১৭ সালে এসে ১০৮ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে পানির স্তর পাওয়া পাচ্ছে। দুই বছরে ৮ ফিট নিচে পানি স্তর চলে গেছে। নতুন করে এখানে গভীর নলক‚প স্থাপন করলে ১৮০ থেকে ২০০ ফিট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে হবে। তাতে এ এলাকার মিঠা পানির সংকট ভয়াভহ আকার ধারণ করবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) প্রকৌশলী মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, জন্যসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার, কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণ, খাস পুকুর-খাল নিয়মিত সংস্কার করা ও নদী খনন করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাধার খ্যাত খাড়ি রয়েছে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এরমধ্যে সংস্কারের অভাবে কিছু খাড়ি ভরাট হয়ে গেছে। সেগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত ১৭০ কি.মি. খাড়ি সংস্কার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো সংস্কার করা হবে। এতে করে ওইসব এলাকার পানির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করা যাবে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্রকৌশলী রোকনুজ্জামন বলেন, বছরের অন্যান্য সময় পানির সরবরাহ কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও খরার সময় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানি কম উঠে। একারণে ওই সময় শহরের কিছু এলাকায় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বাহার উদ্দীন মৃধা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চারটি ও নাচোল উপজেলার চারটি ইউনিয়নে পানির সংকট রয়েছে। আগে ৯০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যেত। এখন সেখানে ১২০/১৩০ ফুট নিচে পানি পওয়া যায়।
তিনি আরও জানান, ওইসব এলাকায় ১৩৫/১৪০ ফুটের নিচে আর পানি পাওয়া যায় না। সেখানে রয়েছে পাথরের লেয়ার। সেই লেয়ার ভেদ করে ৪৫০ থেকে ৫০০ ফুট গভীরেও পানির পরিবর্তে শুধু কাদা মাটি পওয়া যায়। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদী, পুকুর, খাল-বিলের পানি ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে ওই এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিবে এবং মরু করণের দিকে এগিয়ে যাবে।
আরএআর/আরআইপি