যমুনা নদীসহ পানিশূন্য শতাধিক খাল-বিল
পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ কিংবা জীবজন্তু এমনকি কোনো উদ্ভিদও বাঁচতে পারে না। পানির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতি বছর বিশ্ব পানি দিবস পালিত হলেও দীর্ঘ সময়ে সংস্কারের অভাবে সিরাজগঞ্জের যমুনাসহ ২৩টি শাখা নদী ও শতাধিক খাল-বিল এখন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা যমুনা নদীসহ ২৩টি অভ্যন্তরীণ শাখা নদী ও শতাধিক খাল এখন পানিশূন্য হয়ে মৃতপ্রায়। শুধু তাই নয় চলনবিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় প্রায় শতাধিক খাল পানিশুন্য হয়ে পড়ায় ক্রমশই মরাখালে পরিণত হচ্ছে।
এ কারণে সিরাজগঞ্জ জেলাসহ চলনবিলের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, গুরুদাসপুর, সিংড়া ও আত্রাই উপজেলার শত শত গ্রামের লাখ লাখ মানুষের নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায়, আবহাওয়া ও জলবায়ুতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পেশা বদল করেছে আবার কেউ কেউ বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতু ও চলনবিল অঞ্চলের যতদূর চোখ যায় নদীর বুক জুড়ে শুধুই ধূ ধূ বালুচর। কোথাও চাষাবাদ, কোথাও গরু চরানোর কিংবা দুরন্ত কিশোরদের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর দক্ষিণ দিকের ৫নং পিলার থেকে ২৩নং পিলার পর্যন্ত ও উত্তর দিকে ৬নং পিলার থেকে ১৭নং পিলার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশাল আকারের চর জেগে উঠেছে। প্রতি বছর এই সেতুর নিচে সবজীসহ নানা চাষাবাদ শুরু হয়েছে। করালগ্রাসী যমুনার দক্ষিণে পাবনার বেড়াকোলার থেকে উত্তরে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২০০ কি.মি. নদীর অভ্যন্তরে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষাবাদ হতো। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় চাষাবাদ ব্যহত হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, জেলার তাঁত সমৃদ্ধ শাহজাদপুর উপজেলার অন্যতম নৌবন্দর বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে নদীর মাঝপথে প্রকাণ্ড চর জেগে ওঠায় এ বন্দর দুই ধারায় বিভক্ত করে ফেলেছে। পূর্ব অংশে সার তেলবাহী জাহাজ কার্গো যেমন ভিড়ছে তেমনি পশ্চিমপাড়েও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
এ বন্দর ছাড়াও বাহিরকোলা নৌবন্দর, যমুনা নদীর ভূয়াপুর-জগনাথগঞ্জ ঘাট, সিরাজগঞ্জ পুরাতন জেলখানা ঘাট, কাজিপুর ঘাটে বড় বড় স্টিমার লঞ্চ ও নৌকা দেশ-বিদেশে চলাচল করত সে দৃশ্য এখন শুধুই কল্পনার বিষয়। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই নাব্যতা সঙ্কটে পড়ে এ জেলার অধিকাংশ নৌপথেই স্বাভাবিকভাবে কার্গো লঞ্চ নৌকা ও জাহাজ চলাচল করতে পারছে না।
বর্তমানে যমুনা নদী ছাড়া সব অভ্যন্তরীণ নদ-নদী, খাল-বিল মৃতপ্রায়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এগুলো একসময় গভীর নদী ছিল। জেলা থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাতাতের একমাত্র মাধ্যম ছিল এসব নদীপথ। কালের বিবর্তনে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং উজান থেকে আসা বালুমাটিতে এসব নদী ভরাট হয়ে ধূ ধূ চরাঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
নদী মরে যাওয়ায় সেচ কাজ দারুণভাবে ব্যহত হচ্ছে। এতে কৃষিযোগ্য জমির সংখ্যা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। নদী খনন না করায় দেশীয় মাছও বিলুপ্তির পথে। ফলে কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পেশা বদল করেছে কিংবা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সবকিছু মিলিয়ে নদীর বুকে চাষাবাদের বিরূপ প্রভাবের অশনি সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের মতে ঐতিহ্যবাহী নৌবন্দর সিরাজগঞ্জের প্রবাহমান নদীগুলো মরে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীব বৈচিত্রসহ সকল ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
যমুনা বিধৌত উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার নৌবন্দর খ্যাত প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলাই যমুনা নদী বেষ্টিত। বলা যায়, জেলার একভাগ স্থল আর তিনভাগই জল। অথচ নৌবন্দর খ্যাত এ জেলায় এখন নদীগুলোর করুণদশা।
যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ শাখা নদ-নদী ইছামতি, করতোয়া, বড়াল, ফুলজোড়, কাটাখালি, হুড়াসাগর ও গুমানী নদীর যুগের পর যুগ নেই কোনো সংস্কার কিংবা খননের সুব্যবস্থা। ফলে ফুলজোড় নদীতে এক অবাক বিস্ময়ের ঘটনাও সকলের দৃষ্টি কেড়েছে।
সম্প্রতি জেলার হাইওয়ে নলকা ব্রিজের উত্তর পার্শ্বের ফুলজোড় নদীতে সংস্কারের অভাবে পুরো মাত্রায় গভীর জঞ্জালের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ দেখা যায় গরু নদীর উপরাংশে ঘাস খাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে রাখাল সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে। কি আশ্চর্য! নিচে পানি উপরে মাঠ। এক সময় হাজারো মানুষ এখানে ভিড় জমায়। নদীর উপর অংশে খেলাধুলা করে। অথচ পা ডেবে যায় না। এতটা জঞ্জাল পড়ে নদীর এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা থেকেই নদী খনন না করার বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য আভ্যন্তরীণ নদ-নদীর অবস্থা এমন না হলেও শুকিয়ে চৌচির।
এ নদীর পানির ব্যবহার এতটাই বেড়ে গেছে যে, অনেক স্থানে পানির স্তর খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। এবার শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকটে ভুগছে যমুনাসহ আভ্যন্তরীণ শাখা নদীগুলো। ভরাট হয়ে যাওয়া নদী-খাল পুণঃখনন না হওয়ায় ও উজান থেকে পানি আসতে না দেয়ায় নদীগুলো পানিশুন্য হয়ে দেখা দিচ্ছে মরুময়তা।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থসংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার উন্নয়ন করতে কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। কৃষি নির্ভর এ জেলার কৃষকদের সহজে ঋণের ব্যবস্থাসহ নদী খনন ও সেচ ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে হবে।
যমুনার আভ্যন্তরীণ শাখা নদীর দীর্ঘদিন যাবৎ খনন না করায় কৃষকেরা তাদের সেচের অভাবে শষ্য চাষ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত প্রায় নদীর অবৈধ উচ্ছেদ ও নদী সংস্কার করে পুনরায় পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা বাস্তবায়িত কূল রক্ষা হবে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
এফএ/আরআইপি