জীবনে কখনও দ্বিতীয় হননি তিনি
ছোটবেলা থেকে মাকে শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন দেখে মুগ্ধ হওয়া। মাকে চাকরি করতে দেখে নিজের মনে নতুন স্বপ্নবোনা। ওই স্বপ্নকে লালন করে নিজের মনের ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তোলা। সেই সঙ্গে পণ করা আমাকে মায়ের মতো প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবা যেহেতু শিক্ষক সেহেতু বাবাকে আদর্শ মেনে মায়ের অনুপ্রেরণায় নিজেকে গড়ে তোলা।
মা চাকরি করার পাশাপাশি আমার দিকে খেয়াল রাখতেন। আমি যাতে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারি সেদিকে সব সময় কড়া নজরদারি ছিল মায়ের। তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে ভাইয়ের সাহায্য সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। আর বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতা আর অনুপ্রেরণায় আজ এখানে আসতে পেরেছি।
কথাগুলো বলছিলেন, সানজিদা ইয়াছমিন। গত ১৫ জানুয়ারি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগ দেন তিনি।
সানজিদা ইয়াছমিন বাবা মৃত. শামসদ্দিন আহম্মেদ ও মা রওশন জাহানের মেয়ে। তিনি দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার ঈদগাঁ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। তারা এক বোন এক ভাই।
দিনাজপুরের মেয়ে সানজিদা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বার্ষিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পান। জীবনের সব প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন তিনি। কখনও তিনি দ্বিতীয় হননি।
গান শোনা, নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসেন তিনি। ছোটবেলায় তিনি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তি পেয়ে ১৯৮৯ সালে দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন। পরে ১৯৯৫ সালে দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হয়ে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ইনফরমেশন সাইন অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ২০০১ সালে স্নাতক ও ২০০২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
স্নাতক শেষ হওয়ার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় তারই পছন্দের পাত্র ডা. মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে। বিয়ের পর তার স্বামীও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলো ফেসিয়াল সার্জারির ওপর এমএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং বিসিএস ক্যাডারভুক্ত ডাক্তার হয়ে যান।
নিজের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে সানজিদা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, দেড় বছরের মেয়ে সামিহা রহমানকে নিয়ে আমি ২৮তম ও ২৯তম বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি।
মূলত বিসিএসের পড়াশোনা, গাইড, পড়ার প্রতি চাপ, অংক না পারলে করিয়ে দেয়া, বিভিন্ন বিষয় না বুঝলে বুঝিয়ে দেয়া এসব ব্যাপারে আমার স্বামীর উৎসাহ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
একা পড়তে যেন খারাপ না লাগে সে জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একসঙ্গে পড়তাম। অনেক সময় পড়তে ইচ্ছা করতো না। মাঝে মাঝে পড়া নিয়ে তুমুল ঝগড়াও লেগে গেছে আমাদের মধ্যে। তারপরও হাল ছাড়িনি। আমাকে বুঝিয়ে উৎসাহ দিয়ে পড়তে বসিয়েছে সে।
২৮তম বিসিএসে সুযোগ না পেয়ে ২৯তম বিসিএস পরীক্ষাকে সিরিয়াসলি নিতে হয়েছে। অবশেষে ২৯তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে লিখিত ও মৌখিক দুটোকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।
তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনা হয় না। আর সন্তানের মা হয়ে গেলে তো ব্যস্ততার শেষ নেই। লেখাপড়া করলেও কোনো রকমে শেষকরা। সমাজের প্রচলিত এই ধারণাকে আমি বদলে দিয়েছি। দেখিয়েছি, প্রবল ইচ্ছা আর অনুপ্রেরণা থাকলে সবই সম্ভব।
২০১১ সালে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অধীনে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেই।
সবশেষ গত ১৫ জানুয়ারি নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করে কর্মস্থলে আসি। চাকরি অবস্থায় কোল জুড়ে আসে এক ছেলে আসওয়াদ রহমান (৩)। আমি এখন এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মা।
নারীদের উদ্দেশে সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, চেষ্টা আর মনোবল থাকলে জীবনে সফলতা অর্জন করা কঠিন ব্যাপার নয়। নিজের ওপর অাস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে দুরন্ত গতিতে। তবেই নারী সবক্ষেত্রে সফল হবে।
তিনি বলেন, নির্দিষ্ট বয়সের পরে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে গেলে যে আর কিছু করতে পারবে না এটা ভাবা ঠিক না। বিয়েকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকলে ক্যারিয়ার গড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে স্বামী ও পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মো. ছগির হোসেন/এএম/পিআর