নরসিংদীতে আলো ছড়াচ্ছে নারীরা
উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে এগোচ্ছে আমাদের নারী সমাজ। প্রতিভাবান নারীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নিজ কর্মদক্ষতায় আলো ছড়াচ্ছেন চারপাশে। এতে করে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অন্যান্য নারীরা।
সরকারের সময়োপযোগী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে নরসিংদী জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন পদে এমনি করে আলো ছড়াচ্ছেন একাধিক প্রতিভাবান নারী। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ সর্বক্ষেত্রে নারীরা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে।
নরসিংদী বিচার বিভাগের ১৭টি পদের মধ্যে মুখ্য বিচারিক হাকিম (জেলা ও দায়রা জজ) বেগম ফাতেমা নজীব, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্র্যাট শামীমা আফরোজসহ ১১টি পদে অধিষ্ঠ আছেন নারী বিচারক।
সিভিল সার্জন হিসেবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করছেন ডা. সুলতানা রিজিয়া। দুঃস্থ, পঙ্গু, অসহায় ও দরিদ্র নারীদের পূনর্বাসনের লক্ষ্যে বিনা বেতনে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজ সেবা করে যাচ্ছেন নরসিংদী মহিলা পরিষদের সভা নেত্রী আশা লতা সাহা।
জেলা পুলিশ বিভাগের সবোর্চ্চ কর্মকতার পদসহ বেশ কিছু পদে অধিষ্ঠ আছেন নারী কর্মকতা। জেলার পলাশ ও বেলাবোসহ দুই উপজেলায় ইউএনও (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রাট) এর দায়িত্ব পালন করছেন দুই জন প্রতিভাবান নারী। রয়েছেন শিক্ষা বিভাগেও।
সবাইকে পেছনে ফেলে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার আমেনা বেগম। আর্ন্তজাতিক নারী দিবষ উপলক্ষে জাগো নিউজকে জানিয়েছে নিজ জীবনের সফলতার গল্প।
আমেনা বেগম বললেন, আমার সফলতার সকল প্রেরণা জুগিয়েছিলেন আমার বাবা। ছোট বেলা থেকেই তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। বাবার উৎসাহ আর পাশের বাড়ির কাস্টমের মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রাশেদা বেগম নামে এক আন্টিকে দেখেই স্বর্প্ন পুরণের উৎস খুঁজে পাই।
আমেনা বেগমের জন্ম চট্টগ্রামের অগ্রাবাদে। আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি বিদ্যালয়েই লেখাপড়ার হাতে খড়ি। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। সংসারের কাজেও নিয়মিত মাকে সাহায্য করতেন। কিশোরী বয়স থেকেই বাবা শিখিয়েছেন পুথিগত বিদ্যার পাশাপাশি জীবন সাজাতে হলে সকল ব্যবহারিক কাজেও দক্ষতা থাকতে হবে। ভাইদের কাছ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। শিখেছেন সেলাই কাজ, স্ক্রেচিং ও এম্ব্রয়ডারি কাজ।
স্কুল-কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আমেনা বেগম ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএস (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সম্মিলিত মেধাতালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এরপর বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
চাকরি জীবনে প্রথম কুমিল্লা জেলায় সহকারী পুলিশ সুপার (শিক্ষানবীস) হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পরে র্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্ব তিমুরে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমেনা বেগম আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও এই দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ‘প্রথম এশিয়ান উইমেন পুলিশ কনফারেন্স’ এ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। আমেনা বেগম ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক’ এরও প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (এসপি), এআইজি (হাইওয়ে পুলিশ) এবং পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন।
এসব দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে ‘আইজেন হওয়ায় ফেলোশিপ’ এর জন্য মনোনয়ন প্রাপ্ত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যসহ ১৬টি অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে পুলিশিং এর উপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
এছাড়া মেক্সিকো, ইউএসএ, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ইউরোপে পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে সারাবিশ্বে নারী পুলিশ হিসেবে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।
১৯৯৯ সালে চট্রগ্রামের ব্যবসায়ী সানিয়াৎ লুৎফীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর চাকরির সুবাধে আমেনা বেগম বিভিন্ন জেলায় থাকলেও স্বামী সানিয়াৎ থাকেন চট্টগ্রামেই। তাদের রয়েছে এক কন্যা সন্তান। পুলিশ সুপার হিসেবে পুরো জেলার আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকেন সব সময়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমাজে নারী পুরুষের ভেদাবেদকে পাশ কাটিয়ে সফল ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম। নিজের পরিবারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সমানভাবে।
আমেন বলেন, দিন দিন নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। সফলও হচ্ছেন। কিন্তু পুরুষের তুলনায় অনেকটা কম। এর কারণ নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে নারীরা নিজেরাই প্রধান বাধা। এখনো অধিকাংশ নারী নিজেদের চার দেয়ালের বাইরে বের করে আনতে পারেননি। নারীদের এগিয়ে যেতে হলে নিজেদের মনস্তাত্তিক বাধা আগে ভাঙতে হবে।
তছাড়া এবারের নারী দিবসের মূল শ্লোগান হলো ‘সাহসী হও, পরিবর্তন আনো’। তাই প্রতিটা নারীকে অন্যের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। সাহসী হতে হবে। সাহস করে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই পরিবর্তন ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
এফএ/আরআইপি