ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

অভাবের তাড়নায় বাল্যবিয়ে তারপর তালাক

প্রকাশিত: ০৫:০৫ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৭

“সকালে ঘুম থেকে উঠে গাবুর মেয়ের মুখ দেখলে সংসারের আয়-বরকত কমি যায়” উক্তিটি করেন পাঁচগাছি ইউনিয়নের পানাতি পাড়া গ্রামের বাসিন্দা আরকান আলী।

ছয় বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে এই ইউনিয়নের নওয়াবশ গ্রামে ভিটেমাটি সব বিলীন হয়ে আজ নিঃস্ব তিনি। বর্তমানে বড় ভাই এরশাদের বাড়িতে আশ্রিত রয়েছেন। অভাবের তাড়নায় একমাত্র মেয়ে আকলিমাকে (১৯) ভায়রার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। আকলিমা তখন ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে নেশাগ্রস্ত আর বেকার হওয়ার কারণে যৌতুকের চাপে বিয়ের এক বছরের মাথায় তালাকপ্রাপ্ত হয় আকলিমা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে বাবার বাড়িতে দিন কাটাচ্ছে আকলিমা।

আকলিমার বাবা আরো বলেন, কাজ কর্ম না থাকার দরুন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসলেও দেড় থেকে দু’লাখ টাকা যৌতুক চায়। যেখানে খেতেই পারি না ভাল করে সেখানে এতো টাকা দেবো কোথা থেকে।

আকলিমা জানান, মাত্র ১০-১১ বছর বয়সে বাবা-মা জোর করে আমার বিয়ে দেয়। এই বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না। অনেক চাপে পড়ে রাজি হই। স্বামীর খারাপ নেশা আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের কারণে সংসার ভেঙে যায়। একদিকে আমার সংসারও হলো না অন্য দিকে পড়াশুনা করাও হলো না। আগামীতে আমি কিভাবে জীবন পার করবো ভাবলেই দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে।

এমন দুঃস্বপ্ন নেমে আসে একই এলাকার মেয়ে আসমুন্নাহার আসমা (২০)। স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরি করার। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি পড়ে ৪ বছর আগেই। ৮ম শ্রেণি পাস করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকেও। প্রায় সময় স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। টানা ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত না খাইয়ে রাখত। এসব নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত বছর তালাক নেয় পরিবার।

আসমা বলেন, পরিবারের চাপ থাকলেও প্রথমে বিয়েতে রাজি হইনি কিন্তু প্রতিবেশীদের দুর্ণামের ভয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। আজ বাবা-মায়ের সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে পড়ে আছি। স্বপ্ন পূরণ করতে না পারায় বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি।

আসমার মা কহিনুর বেগম বলেন, অভাবের সংসারে ৬ ছেলে-মেয়েসহ ৮ জনের সংসার। একজনের আয়ে সংসার চালানো খুব দায়। এরমধ্যে বড় মেয়ে আসমা গাবুর (যুবতি) হয়ে উঠেছে। ভাল সমন্ধ আসায় ধার দেনা আর জমি বন্ধক রেখে সাইকেলসহ ৭০ হাজার টাকা যৌতুক দেই। কিন্তু ছেলে বেকার থাকায় মেয়ে আমাদের বাড়িতে রাখি। মাঝে মধ্যে মেয়ে ওখানে যায়। সংসার টিকিয়ে রাখতে বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের টাকার লোভ আর মেয়েকে মারধর করার জন্য তালাক নেই। মামলা মোকাদ্দমা করেও কোনো লাভ হয়নি।

আসমার বাবা আজিজুল হক জানান, মধ্যকুমোর পুরের মোল্লা পাড়ার মৃত হযরত আলীর ছেলে খোরশেদ আলমের সঙ্গে বিয়ে দেই। ঘটকের কথা বিশ্বাস করে বড় ভুল করেছি। মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করে ফেলেছি আমরা।

উলিপুর উপঝেরার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের শিমুলতলা পাড়ার মেয়ে লাভলি খাতুন। বয়স সবে মাত্র ১৭। এরমধ্যে ১৪ মাসের একটি কন্যা সন্তান আফিফাকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তিন মাস আগে সংসারে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট লাভলি। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় পাশের গ্রামের জনতারহাট মুসল্লী পাড়ার কসাই আবু বক্করের ছেলে আতিকুর রহমান (২০) এর সঙ্গে বিয়ে হয়। লাভলির বাবা আদব আলী একজন কৃষক।

লাভলি খাতুন বলে, দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আর ভাইরা আলাদা খাওয়ায় সংসারে অভাব দেখা দেয়। আর এজন্য আমাকে সাইকেলসহ ৬৩ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয় ২০১৪ সালে। বেকার ছেলের যৌতুকের টাকা আরো চেয়ে মারধর শুরু করে। এরমধ্যে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া এই নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এক প্রকার অতিষ্ঠ হয়েই তালাক নেই। ছোট্ট শিশু আফিফাকে কোলে নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে লাভলি।

এমন দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ের স্বীকার মেয়েরা। দিন যত যাচ্ছে তালাকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে  বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে দারিদ্রতা আর পুষ্টিহীনতার সংখ্যাও বাড়ছে।

বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাল্যবিয়ের কারণে মায়েরা অপুষ্ঠিতে ভোগে এবং পুষ্টিহীন শিশুর জন্ম দেয়। পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।

এ্যাফাদের নির্বাহী পরিচালক সাঈদা ইয়াসমিন জানান, জেলার ৭৮ ভাগ মেয়েই বাল্যবিয়ের স্বীকার। এরমধ্যে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মেয়েই তালাকপ্রাপ্ত হয়। বাল্যবিয়ের কারণে একদিকে মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে অপরদিকে সমাজে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। রাষ্ট্র যদি দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয় তাহলে সমাজে এক প্রকার বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বুড়াবুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান একরামুল হক খন্দকার বলেন, জেলার সবচেয়ে বাল্যবিয়ের কারণে এখানে তালাকের সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ইউনিয়নে ২০ থেকে ৩০ ভাগ মেয়ে ইতোমধ্যে তালাকপ্রাপ্ত হয়েছে। ইউপি পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা উঠান বৈঠকসহ সচেতনমূলক অনেক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি।

এফএ/আরআইপি

আরও পড়ুন