‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে অ্যাডিশনাল এসপি!
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের সহযোগিতা করতেন মতিউর রহমান সরকার। তার বাবা ছিলেন শান্তি কমিটির সভাপতি। রাজাকার হয়েও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠেছে মতিউর রহমানের। পাচ্ছেন সম্মানী ভাতাও।
এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-অ্যাডিশনাল এসপি) হয়েছেন তার ছেলে শামসুল আলম সরকার লিটন। বর্তমানে শামসুল আলম ফেনী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বিএনপির শীর্ষ নেতা হয়েও আওয়ামী লীগের এমপির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। মোহাম্মদ মতিউর রহমান কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মৃত শামসুল হক সরকারের ছেলে।
এতদিন বিষয়টি গোপন থাকলেও একজন রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী। সেই সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে তার ছেলেকে নিয়োগ দেয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়।
এ ঘটনার পর ‘রাজাকার’ মতিউর রহমান সরকারের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেয়া, সাময়িক সনদ বাতিল, সস্মানী ভাতা বন্ধসহ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
প্রশাসন আর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল বলছে, মতিউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আর অভিযুক্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান সরকারের দাবি, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার ষড়যন্ত্র।
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্ধুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মতিউর রহমান সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। তিনি পাকুন্দিয়ায় পাঞ্জাবি ক্যাম্পে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও বাড়িঘরের তালিকা সরবরাহ করতেন।
তার বাবা উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের চরদেওকান্দি গ্রামের বাসিন্দা শামসুল হক সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নির্দেশে এলাকায় অসংখ্য হিন্দু পরিবারকে নির্যাতন, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। মঠখোলা বাজারে ৮ জন হিন্দু গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয় বলেও অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন মতিউর রহমান। বর্তমানে তিনি সরকারের সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার ছেলের চাকরি হয়েছে সহকারী পুলিশ সুপার পদে।
এ ব্যাপারে গত ৪ জানুয়ারি পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার কাছে স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এর পর থেকে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়।
পাকুন্দিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলী বলেন, মতিউর রহমান রাজাকার ছিলেন। এটা সবাই জানে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন খবর পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের কাছে সরবরাহ করতেন। তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকা আমাদের জন্য বড়ই লজ্জার।
পাকুন্দিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার মিসবাহ উদ্দিন বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সুযোগে মতিউর রহমান নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। আগামী ২১ জানুয়ারি তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা সেটি যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, মতিউর রহমান একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তিনি রাজাকারদের হয়ে কাজ করতেন। তার বাবা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় টাকা দিয়ে স্থানীয়দের ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন।
তিনি আরও বলেন, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ভারতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তা ও সরকারি গেজেটে থাকতে হবে। কিন্তু মতিউর রহমান সরকারের নাম গেজেট ছাড়া আর কোথাও নেই। যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির উদ্দিন অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার বলে বলেন, অভিযোগটি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত এগারসিন্দুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান সরকার তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে বলেন, বিএনপি সরকারের সময় গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নাম উঠেছে। মন্ত্রণালয় থেকে একটি সাময়িক সনদও দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় কিছু মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ থাকায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন ঠিক মনে নেই। তবে কাগজপত্র দেখে বলতে পারবো।
নূর মোহাম্মদ/এএম/জেআইএম