বগুড়ায় গরুর নকল দুধ তৈরির কারখানার সন্ধান
গরুর দুধে পানি মেশানোর কথা শোনা গেলেও বগুড়ায় এবার পানি ছাড়াও সোয়াবিন তেল ও কেমিক্যাল মিশিয়ে খাঁটি দুধ তৈরি করার কারখানার সন্ধান মিলেছে। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে এই দুধ বাজারজাত করা হচ্ছে।
অসাধু এই চক্রের অন্যতম ক্রেতা হলেন ব্র্যাক দুগ্ধ সেন্টার। এছাড়াও বিভিন্ন হাট-বাজার ও বাসাবাড়িতে গত দুই বছরে প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার লিটার ক্ষতিকর রাসায়নিক এই দুধ বিক্রি করা হয়েছে।
রোববার গোয়েন্দা পুলিশ বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় গরুর নকল দুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালায়। এসময় সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় গরুর নকল দুধ তৈরির তিনজন কারিগরকে। অভিযানকালে সেখানে পাওয়া যায় ১০০ লিটার গরুর নকল দুধ এবং আড়াই হাজার লিটার দুধ তৈরি করার মতো সমপরিমান কেমিক্যাল ও বিভিন্ন সরঞ্জাম।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের একটি দল রোববার সোনাতলা উপজেলার শিহিপুর মধ্যপাড়া গ্রামের আলহাজ্ব আব্দুল মান্নানের বাড়িতে অভিযান চালায়। ওই বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় পাবনার বেড়া উপজেলার নাকালিয়া গ্রামের সরজিত ঘাষ, পাটুরিয়া পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুল হান্নান ও সোনাতলার পাকুল্লা ঘোষ পাড়ার সজিব কুমার ঘোষকে। তারা ওই বাড়ি ভাড়া নিয়ে গরুর নকল দুধ তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিল।
গোয়েন্দা পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে ১০০ লিটার গরুর নকল দুধ, ১০ কেজি পার অক্সাইড, ২৫ কেজি হোয়াইট পাউডার, ১০ কেজি গ্লকোজ পাউডার, ৫টি ব্লেন্ডার মেশিন, ২০ লিটার সোয়াবিন তেল, ৪টি বড় সাইজের অ্যালুমনিয়ামের পাতিল ছাড়াও বিভিন্ন সরঞ্জাম আটক করে। গত দুই বছর ধরে প্রতিদিন ৫০০ লিটার করে দুধ তারা সরবরাহ করেছিল।
অভিযোগ রয়েছে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি নকল এই দুধের অন্যতম ক্রেতা হলেন সোনাতলাস্থ ব্র্যাক দুগ্ধ সেন্টার। এরা প্রতিদিন দুই থেকে ৩০০ লিটার এই দুধ ক্রয় করে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টের মিল্ক কালেকশন ও চিলিং সেন্টারেও অ্যালকোহল, সালফিউরিক এসিড, নাইটটিক এসিড, সোডিয়াম হাইডোকোরিক এসিডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল পদার্থ রয়েছে।
এই সংস্থার কর্মরত একজন সহকারী কর্মকর্তা জানান, দুধে চিনি, লবণ, সোডা, ভাতের মাড় বা ময়দা মেশানো আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য এ সকল কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। তাহলে কি করে বিগত দুই বছর ধরে এই দুধ ক্রয় করা হচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
পুলিশ জানায় গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, তারা অল্প পরিমাণ গরুর খাঁটি দুধের সঙ্গে পানি, সোয়াবিন তেল, পার অক্সাইড, হোয়াইট পাউডার ব্লেন্ডার মেশিনের সঙ্গে মিশ্রিত করে দুধের ফ্লেভার ও রং তৈরি করছিল। এরপর নকল ওই দুধ খাঁটি গরুর দুধ হিসেবে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা ছাড়াও ব্র্যাকের দুধ ক্রয় কেন্দ্রে গত দুই বছর যাবত সরবরাহ করে আসছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পদ্ধতি ছাড়াও নকল দুধ তৈরি কারখানা প্রথমে দুধ থেকে ননী তুলে নেয়। তারপর ছানা তৈরি করে। ছানার পানিতে কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করে নকল দুধ। ৩৭ লিটার ছানার পানি ও খাবার পানির সঙ্গে তিন লিটার দুধের ননী, ৫০ গ্রাম খাইসোডা, কয়েক চামচ পার অক্সাইড, ময়দা, চিনি জ্বালিয়ে তাতে সোয়াবিন তেল ও দুধের সুবাস তৈরির এসেন্স মিশিয়ে তৈরি হয় ৪০ লিটার নকল দুধ।
দুধ সাধারণত ৬ ঘণ্টার বেশি সতেজ থাকে না। যে কারণে এতে মেশানো হয় বিষাক্ত ফরমালিন। এসব দুধ দেশের নামি দামি ডেইরি প্রজেক্ট ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়।
সোনাতলা এলাকার দুধ ব্যবসায়ী দিজেন্দ্র নাথ ঘোষ দাবি করেন, নকল দুধ দিয়ে বাজার ভরা। তবে কোনো ঘোষই নকল দুধ তৈরি করেন না। তার দাবি দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের লোকেরা নকল দুধ তৈরি করে।
প্রান্তিক গো-খামারি আবুল হোসেন আপেক্ষ করে বলেন, নকল বাজদের কারণে আমরা বিপাকে পড়েছি। আগে বাসাবাড়িতে প্রতিদিন দুধ দিয়ে সপ্তাহ পর টাকা নিয়ে ওই টাকায় গো-খাদ্য কিনতাম। এখন প্যাকেট দুধের কারণে সেটিও সম্ভব হয় না।
বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. অর্ধেন্দু দেব জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত এসব নকল দুধ খেলে মানবদেহে পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সিরাজুল আলম বাপ্পী জানান, এ ধরনের নকল গরুর দুধ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই দুধ নিয়মিত পান করলে শিশুদের কিডনী নষ্ট হয়ে যাওয়া, ব্রেইনে রক্ত ক্ষরণ ছাড়াও মেধা বিকাশে চরম অন্তরায়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা ছাড়াও আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানানো হবে।
এআরএ/আরআইপি