কাপ্তাই লেক দখল করে অবৈধ স্থাপনা
দখলের কবলে পড়েছে রাঙামাটির কাপ্তাই লেক। শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় লেকের পাড় ও জলমহাল দখল করে রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে বাড়িঘরসহ প্রচুর অবৈধ স্থাপনা। এতে বাড়ছে নানা ঝুঁকি। আর দূষণের শিকার হচ্ছে জনস্বাস্থ্যসহ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ।
সরেজমিন শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাপ্তাই লেকের পাড়ে চলছে দখলের হিড়িক। বিভিন্ন জায়গায় লেকের পাড়, জলমহাল ও ভাসমান টিলা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে যত্রতত্র বাড়িঘরসহ প্রচুর স্থাপনা। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হচ্ছে পাকা দালান।
জেলা প্রশাসন পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, এসব স্থাপনার বেশিভাগই অবৈধ, অনুমোদিত ও রেকর্ড ছাড়া। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে রাঙামাটি শহরে জানমালের ঝুঁকি বাড়ছে। হুমকিতে পড়ছে লেক, তার আশপাশের এলাকা এবং শহরের লোকজন।
সম্প্রতি শহরের মহিলা কলেজ রোডে এ ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ দ্বিতল ভবন ধসে তলিয়ে যায় কাপ্তাই লেকের পানিতে। এতে আটকা পড়ে তিন শিশুসহ পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে।
এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, যে স্থানে ধসে পড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে সেটি একেবারে ঢালু জায়গা। রাস্তার মাটি কেটে ভরাট করা জায়গায় সেটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটির কোনো নকশার অনুমোদন ছিল না। জলমহালের ঢালু জায়গায় ভরাট করা মাটিতে ওই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করার ফলে ভরাট করা মাটি পানিতে নরম হয়ে যায়। ফলে মাটি তার ভারবহন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
লেকের পাড় ও জলমহাল দখল করে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে প্রচুর। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর করে ভাড়া দিয়ে সিন্ডিকেট করে যারা লাভবান হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা দরকার।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বলেন, রাঙামাটি শহরে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘরের তালিকা প্রণয়নের জন্য পৌরসভাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তালিকা এখনও হাতে পাওয়া যায়নি।
তিনি আরো বলেন, রাঙামাটি শহরে এ ধরনের অনুমোদনবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ঘরবাড়ি রয়েছে। যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলো চিহ্নিত করে তালিকা প্রণয়ন করে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা দরকার। তবে তা রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। কারণ উচ্ছেদের আগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে নামা পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে কাপ্তাই লেক। এতে লেক নাব্যতা হারিয়ে জেগে উঠছে চর ও উঁচু ভূমি। আর সেসব ভরাট হওয়া জমি অবাধে দখল করা হচ্ছে। লেকের আনাচে-কানাচে শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকাতেও চলছে দখলের মহোৎসব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাঙামাটিতে পাকা ভবন ও ইমারত নির্মাণ কাজে বিল্ডিং কোড বা ইমারত নির্মাণ আইন মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে শহরের পৌর এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে হলে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তা না মেনে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর, ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করছে।
সরেজমিন দেখা যায়, রাঙামাটি শহরে রিজার্ভ বাজার, পুরাতন বাস স্টেশন, এসপি অফিসের নিচে, ফিশারি ঘাট এলাকা, পৌরসভা সংলগ্ন, বনরূপা, পাবলিক হেলথ, রাজবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার আশপাশে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে সারি সারি অসংখ্য স্থাপনা ও পাকা বাড়ি। এইসব স্থাপনা মাটি কেটে ও ভরাট করে পাহাড়ের ঢালুতে নির্মিত হয়েছে।
এলাকাবাসীর পক্ষে শাহাদাত হোসেন, আবদুল বাতেনসহ কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা বলেন, আমরা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত আবেদন দিয়েছি। কয়েক বছর ধরে গুটিকয়েক প্রভাবশালী লোক জেলা প্রশাসক বাংলো সড়কের উভয় পাশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে রাতারাতি জমিদার বনে গেছেন।
একই এলাকায় মনির নামে এক সরকারি কর্মচারী একাধিক দোকান ও ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে জমিদার বনে গেছেন। টার্নিংয়ের বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত মো. ছাওয়াল সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা এবং সরকারি রাস্তার ওপর বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে অনেক ঘর স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
এছাড়া আগে জেলা প্রশাসকের গাড়ি চালক তার সামান্য রেকর্ডকৃত জায়গার দোহাই দিয়ে এডিসির গাড়ি রাখার গ্যারেজসহ ঘেরাবেড়া দিয়ে সরকারি রাস্তা পর্যন্ত দখল করে একাধিক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেন। তার সামনে কর্মচারী মনিরও জমিদার বনেছেন। লোকজন কিছু বললে তারা বলেন, আমরা ডিসির লোক।
তবে এসব দখলদারের মধ্যে সরকারি কর্মচারী মনির ও স্পিডবোট চালক আমির হোসেনের এক ছেলে বলেন, তারা নিজেদের রেকর্ডকৃত জায়গায় বাড়িঘর করেছেন। এলাকার গুটিকয়েক লোক ঈর্ষান্বিত হয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাঁধ। এতে সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি কাপ্তাই লেক। যার আয়তন প্রায় সাড়ে ৭০০ বর্গকিলোমিটার।
সুশীল প্রসাদ চাকমা/এফএ/পিআর