ফেসবুক ব্যবহার করে মামুন এখন বাংলাদেশের আইকন
মামুন বিশ্বাস। পেশায় সাংবাদিক। ছোট খাটো ব্যবসাও আছে তার। সব থেকে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন পরপোকারী। দেশের যে কোনো জেলার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। সংবাদ মাধ্যম অথবা নিজেই অসহায় মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে তিনি ফেসবুকে সাহায্য আবেদন করেন। অবাক ব্যাপার হলো মামুন বিশ্বাসের এসব আহ্বানে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই সাড়া দিয়ে অর্থ পাঠান তার কাছে। কারণ সেই বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন ভিন্ন পদ্ধতিতে। যারাই সহযোগিতা পাঠাতো তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সেটি ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন সবাইকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবার সহযোগিতাগুলো প্রকাশ করতে তিনি। তার এসব কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে প্রচার পেয়েছে দেশের সেরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে। এরপর থেকে বিশ্বাসের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা বাড়তে থাকে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আগনুকালী গ্রামের মামুন বিশ্বাস এখন দেশজুড়ে মানব সেবার অন্যতম আইকনে পরিণত হয়েছেন। ফেসবুকে সবার কাছে মামুন এখন রোল মডেল।
প্রতিবন্ধীদের যে কি কষ্ট মামুন তার প্রতিবন্ধী বোনকে দেখে বুঝতে পারেন। মামুন একদিন খুকনী গ্রামে চা খাওয়ার জন্য বাইক থামান। পাশ দিয়ে ফেরদৌস নামের একটা বাচ্চা মাটি দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে আর অন্য শিশুরা পা দিয়ে তাকে লাথি মারছে। এই দৃশ্য এখনো মামুনকে নাড়া দেয়। সেদিন থেকে মাথায় কাজ করে ফেসবুক দিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার।
এরপর ওই দোকানে গিয়ে সেই প্রতিবন্ধী শিশুটির তথ্য যোগাড় করেন। সেদিন রাতেই নিজের ফেসবুকে ওই শিশুকে নিয়ে পোস্ট দেন এবং সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন। এরপর থেকেই মামুন একের পর এক কাজ করে যেতে থাকেন।
আস্তে আস্তে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের ঘিরে ফেসবুকে মামুনের একটা জগৎ গড়ে ওঠে। একসময় ফেসবুকে মামুনের এসব কর্মকাণ্ডকে অনেকেই ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করেছেন। অনেকে অনেক উপহাস করেছেন। কিন্ত কেউ দমাতে পারেন নি তাকে। এই কাজে মামুনের বাবা মাহাবুবুল হোসেন জোস্না ও ভাইয়া মুক্তা বিশ্বাসের অবদান ও অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন মামুন।
মামুন জানান, এ পর্যন্ত ফেসবুকের মাধ্যমে ১০ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৫ টাকা ও ১৩টি হুইল চেয়ার সঙ্গে ১০ শতাংশ জমি অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের মাঝে দিয়েছেন। ফেরদৌসকে দুটি হুইল চেয়ার, নগদ ৫০ হাজার টাকা, সাভার সিআরপি স্কুলে লেখাপড়া করানো, কানাডা থেকে প্রতিমাসে ৫ হাজার করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা, হার্ট ছিদ্র হিমুকে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৫ টাকা, প্যারালাইজড মুক্তিযোদ্ধার প্রতিবন্ধী দুটি ছেলেকে দুটি হুইল চেয়ার ও ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দোকান, রুমাকে দুটি হুইল চেয়ার নগদ ৪৫ হাজার টাকা ও ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দোকান, নাসিমাকে দুটি হুইল চেয়ার, নগদ ৫ হাজার টাকা ও তিনটি ছাগল, ব্লাড ক্যান্সার ফাতেমাকে ৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, আয়শাকে ১০ শতাংশ জমি ও ১৯ হাজার টাকা, আজিজুলকে একটি হুইল চেয়ার ও ১৭ হাজার টাকা, শাকিলকে লেখা পড়ার জন্য ৬ হাজার টাকা, অসহায় হাজেরা বেগমকে ২৮ হাজার টাকা, শ্রী আনন্দ সরকারকে ৪৫ হাজার টাকা, ফুয়ারাকে চোখ অপারেশন এর জন্য ১১ হাজার টাকা, আবিরের চিকিৎসার জন্য ৩৯ হাজার টাকা, শুম্ভ সাহাকে গরু কেনার জন্য ৩৭ হাজার টাকা, মুন্টুর জন্য ২২ শত টাকা, শিমুলের লেখাপড়ার জন্য ৬ হাজার টাকা, তানজিলাকে ৩ হাজার টাকা, জহুরুলকে একটি হুইল চেয়ার ও ২০০০ টাকা এবং সামিউল, হাসান ও লায়লাকে একটি করে হুইল চেয়ার দিয়েছি।
মামুন বিশ্বাস জানান, বাঙালি মাত্রই নানা রঙে-ঢঙে সেজে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিতে মেতে ওঠেন। কিন্তু আমি ফেসবুককে বরণ করেছি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমভাবে। প্রথমে গ্রামের প্রতিবন্ধীদের সমস্যার কথা ফেসবুকে তুলে ধরি। এতে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম আহমেদ ও সহকারী কমিশনার ভূমি আরিফুজ্জামান আমার ফেসবুকে পোস্ট দেখে সেগুলো সমাধান করেন।
তিনি আরো জানান, আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি এই সময়টা যদি ভালো কাজে লাগাই তাহলে অনেক অসহায় মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। আমি যদি ৬৪ জেলায় ৬৪ জন দক্ষ লোক গড়াতে পারি তাইলে এই ফেসবুক দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের জন্য।
এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আহমেদ জানান, আসলে মামুনের সঙ্গে আমার পরিচয় পাখির অভয়াশ্রম নিয়ে। মামুন পাখির অভয়াশ্রমের পাশাপাশি ফেসবুকে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পোস্ট দিচ্ছে আমরা উপজেলা প্রসাশন পদক্ষেপ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মামুন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে ফেসবুকে দিয়ে, একদিন সারাদেশে রোল মডেল হয়ে দাঁড়াবে সে। এই জন্য আমাদের সবার উচিত মামুনের পাশে দাঁড়ানো।
এমএএস/এবিএস