মাংসের চাহিদা পূরণে আসছে বেঙ্গল মিট
ভোজন রসিক আর গরুর মাংসের মেজবানির জন্য সারাদেশেই খ্যাতি আছে চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামের মানুষই সবচেয়ে বেশি গরুর মাংস খান। বড় বড় গরু জবাই করে মেজবানির আয়োজন চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের এই বিপুল পরিমাণ মাংসের চাহিদা পূরণে নেই কোনো স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা।
নোংরা আবর্জনা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু জবাই করে কসাইরা প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে মাংস বিক্রি করে। যে গরু জবাই হয় তার কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না। গরুর মাংস বলে চালিয়ে দেয়া হয় মহিষের মাংস। কখনো কখনো অসুস্থ বা মৃত গরুর মাংসও বিক্রির খবর পাওয়া যায়।
কিন্তু চট্টগ্রামবাসীকে এমন প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে সুস্থ দেশীয় গরুর মানসম্মত গরুর মাংসের চাহিদা পূরণ করতে চট্টগ্রামের বাজারে আসছে বেঙ্গল মিট। এই বেঙ্গল মিটই বাংলাদেশের একমাত্র বৃহত্তম সর্বাধুনিক মিট প্রসেসিং কারখানা।
যেখানে নিজেদের খামারে লালিত গরু, চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়ম মেনে হালাল পদ্ধতিতে জবাই করা হয়। জবাইয়ের পর সেই গরু সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মাত্র ৩ মিনিটে প্রসেসিং করে ফ্রিজিং করে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএম আসিফ জানান, বাংলাদেশের সব তারকা হোটেলসহ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেঙ্গল মিটে প্রসেসিং করা গরু, খাসি, হাস, মুরগি ও কবুতরের মাংসের চাহিদা রয়েছে।
দীর্ঘদিন পরে হলেও চট্টগ্রামের তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদের মাধ্যমে বেঙ্গল মিট এবার প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে। গরুর মাংসের বৃহত্তম ভোক্তা চট্টগ্রামবাসীর হালাল এবং স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে বেঙ্গল মিট।
বেঙ্গল মিটের সিইও এএফএম আসিফ আরো জানান, বেঙ্গল মিট বাংলাদেশে প্রথম ফ্রেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের যোগান দিয়ে থাকে। নিজেদের খামারে গরু লালন পালন করে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রেখে সেই গরুর চাহিদা অনুযায়ী জবাই করা হয়।
বেঙ্গল মিটের প্রায় একশ বিঘার মতো জমি রয়েছে। এই জমিতে গরুর জন্য স্বাস্থ্যকর ঘাসের চাষ করা হয়। সেই ঘাস খাইয়ে গরু লালন পালন করা হয়। উৎপাদিত ঘাস প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে লালন-পালন করা পশুদের খেতে দেওয়া হয়।
গরু ও ছাগল বা খাসি বড় করা হয় এখানে। ঘাসের পাশাপাশি ভুট্টার চাষ করা হয় পশুখাদ্য হিসেবে। এখানে পালিত প্রতিটি গরু ও খাসির কানে একটি করে কোড থাকে। এই কোড কম্পিউটারে বিশেষ সফটওয়্যারে দিলেই ওই গরু বা খাসির জন্মবৃত্তান্ত, সুস্থতা অসুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
বেঙ্গল মিটে গরু জবাই প্রক্রিয়া
বেঙ্গল মিটে প্রতিটি গরু জবাই করার আগে নির্দিষ্ট একটি ‘হোল্ডিং’ এলাকাতে রাখা হয়। মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করার আগে যেমন শুধু পানি খেতে দেয়া হয় এখানেও জবাই করার আগে একই নিয়ম মানা হয়।
এর মধ্যে জবাই করার আগে একজন পশু চিকিৎসক গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন। এই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর একজন দক্ষ আলেম ইসলামী হালাল পদ্ধতিতে সেই গরু জবাই করেন। জবাই হওয়ার পরে আবার সেই গরু ‘পোস্ট মর্টেম’ করা হয়। এইভাবেই নিশ্চিত করা হয় ক্রেতা কোনো সমস্যাযুক্ত বা অসুস্থ গরুর মাংস বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন না।
গরু জবাই হয়ে গেলে বেশি সময় উন্মুক্ত রাখলে মাংসে জীবাণু আক্রান্ত হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে জবাইয়ের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই বিশ্বের সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে সেই গরু প্রসেসিং করে ফ্রিজিং করা হয়। জবাই করার সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মনোনীত ব্যক্তি সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকেন হালাল রীতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
চট্টগ্রামেই গরুর মাংসের ব্যাপক চাহিদা এই অবস্থায় চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ হালাল মাংসের নিশ্চয়তা কীভাবে দিবেন জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদ জানান, প্রথমত বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গাইডলাইন মেনে মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বেঙ্গল মিট।
এই গাইডলাইন প্রস্তুত হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প প্রতিনিধি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সমন্বয়ে। এছাড়াও জাকিম মালয়েশিয়া হালাল মাংস উৎপাদনের রীতি অনুসরণ করা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
বেঙ্গল মিটের কারিগরি উপদেষ্টা অস্ট্রেলীয় প্রকৌশলী ওয়েইন গ্যাস্কেল জানান, গরুর মাংস যে কাটার পর পরই রান্না করলে সবচাইতে ভালো স্বাদ পাওয়া যাবে তা নয়। বেঙ্গল মিটে মাংস কাটাকাটি করা হয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়।
রীতিমতো মাইনাস ডিগ্রিতে চলে এই কাটাকাটির কাজ। জ্যাকেট পরে কর্মীরা কাজ করেন। শরীরে জ্যাকেট আর মাথায় নেট থাকে সবার, যাতে মাংসে কোনো অযাচিত কিছু ঢুকে না পড়ে। এই কারখানায় ঢুকতে গেলে রীতিমতো গামবুট পড়ে ঢুকতে হয়। সানিটাইজারে ধুতে হবে পায়ের বুট ও হাত।
ছোট একটি জলাধারে এমন করে রাখা এই সানিটাইজার যে, কোনোভাবেই কেউ না পাড়িয়ে ঢুকতে পারবেন না এই কারখানার ভেতর। আর পশু জবাই অংশের কর্মচারীরা কোনো ভাবেই মাংস কাটার ইউনিটে ঢুকতে পারবেন না। বেঙ্গল মিটের পুরো ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন প্রায় ৩ শতাধিক কর্মী।
চট্টগ্রামে বেঙ্গল মিট
বেঙ্গল মিটের চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদ জানান, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে বেঙ্গল মিটের বাজার। দেশে গরুর মাংসের বড় বাজার চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করছে বেঙ্গল মিট।
চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসন, পেনিনসুলাসহ সব তারকা হোটেল বেঙ্গলমিটের প্রধান গ্রাহক হলেও চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ এই বিশুদ্ধ রোগমুক্ত গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ পেতো না।
জীবন মুছা/এসএস/আরআইপি