তিনদিন সিদ্ধ আলু খেয়ে কাটিয়েছে নিহত রশিদের পরিবার
রাহিলা আকতার (৬)। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তিন দিন ধরে সিদ্ধ আলু খেয়ে ছিল সে। ভাত খেতে চাইলে বাবা বাড়ি থেকে কাজে যাওয়ার সময় তাকে বলে গিয়েছিল চাল নিয়ে আসবে, তার পর ভাত রান্না হবে, সবাই মিলে এক সাথে ভাত খাবে। মাকে যেন বিরক্ত না করে। মঙ্গলবার সে জানতে পারে বাবা আসবে। শুনে সে সারাদিন আশে পাশে সবাইকে বলে বেড়িয়েছে তার বাবা চাল নিয়ে আসবে। সে ভাত খাবে।
বাবা বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু, চাল নিয়ে আসেনি। এ জন্য সে অভিমান করে বাবার সাথে আড়ি পেতেছে। সে আর বাবার সাথে কথা বলবেনা। অবুঝ এই শিশুটি এখনো বুঝতে পারেনি তার বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে।
বুধবার যখন খবর সংগ্রহ করার জন্য এ প্রতিবেদক তাদের বাড়িতে যায়, তখনো ছবি তুলবো শুনে খুশিতে হাসছিল, তার ছবি তোলা হবে।
জোহরের আযান পড়ছে। ঠিক সে সময় কয়েকজন সাংবাদিক পেট্রল বোমার আগুনে পুড়ে নিহত দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামে আব্দুর রশিদ (৩৮) এর বাড়িতে উপস্থিত হলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই।
আমাদের দেখার পর নিহত আব্দুর রশিদের চাচাতো বোন আর্জিনা বেগম এগিয়ে এসে জানালো, নিহত আব্দুর রশিদের স্ত্রী সুলতানা বেগম স্বামীর ব্যবহৃত কাপড় কাচাঁর জন্য গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহীত পূর্ণভবা নদীতে গেছেন। চার কন্যা সন্তানের মধ্যে ছোট দুই মেয়ে আফসানা মিমি (১৩) ও রাহিলা আকতার (৬) তরকারীর জন্য ঘিমা শাক তুলতে নদীর ধারে গেছে। বড় দুই মেয়ে রোজিনা (২০) ও আদুরী (১৮) বাবার দাফন হবার পর রাতেই চলে গেছে শশুড় বাড়ি।
খবর পেয়ে আব্দুর রশিদের স্ত্রী ও দুই মেয়ে আমাদের কাছে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
এক পর্যায়ে শান্ত হয়ে আব্দুর রশিদের স্ত্রী জানায়, কেউ তাদের খবর নিতে আসেনি। বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। অবরোধের কারণে তিন দিন ধরে আলু সিদ্ধ খেয়ে থাকার পর নিরুপায় হয়ে তার স্বামী কাজে গিয়েছিল সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দেয়ার জন্য। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া কন্যা আফসানা মিমি বাবাকে বলেছিল তারা না খেয়ে থাকবে হরতাল অবরোধের মধ্যে গাড়িতে কাজ করতে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু, বাবার মন তা মানেনি। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে না থাকতে পেরে আব্দুর রশিদ বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি জেনেও কাজে গিয়েছিল। আমরা যখন কথা বলছিলাম তখনো রাহিলা আকতারের হাতে নদীর ধার থেকে তরকারীর জন্য তুলে নিয়ে আসা ঘিমা শাক হাতে ছিল।
আব্দুর রশিদের স্ত্রী সুলতানা বেগম জানায়, দ্বিতীয় মেয়ে আদুরীর বিয়ে হয়েছে এক বছর হয়নি। সে এখন গর্ভবতী। মেয়ের শশুড় ও জামাই মাটি দিয়ে যাওয়ার সময় যৌতুকের বকেয়া টাকা না দিলে মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে যাবে বলে গেছে। এখন তিনি ছোট দুই মেয়েকে কি খাওয়াবেন, কেমন করে পড়ালেখা করাবেন ও কি ভাবে আদুরীর বিয়েতে দিতে চাওয়া যৌতুকের বকেয়া ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করবেন। এই চিন্তায় আকাশ যেন তার মাথায় ভেঙ্গে পড়ছে।
বড় মেয়ে রোজিনার জামাই নাজমুল ইসলাম জানায়, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ দিনে তার শশুড়ের চিকিৎসা চলাকালে কেই তার খবর নিতে আসেনি। এমন কি ট্রাকের মালিক শহরের ঈদগাহবস্তি এলাকার মিজানুর রহমান মিজানো তাদের খবর নেয়নি। চড়া সুদে টাকা নিয়ে শ্বশুরের চিকিৎসা করিয়েছেন। মারা যাওয়ার পর প্রতিবেশি চাচা শ্বশুর রংপুর থানা পুলিশের এসআই নুর নবী অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ নিয়ে দিনাজপুরে এসে দাফনের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন।
নিহত আব্দুর রশিদের স্ত্রী সুলতানা বেগমের কাছে শাশুড়ি কথায় জানতে চাইলে তিনি জানান, তার শাশুড়ী জুলেখা বেওয়া (৭০) মানুষের বাসায় কাজ করেন। সন্তান হারানোর শোক মাথায় নিয়ে পেটের দায়ে কাজ করতে গেছেন।
নিহত আব্দুর রশিদের পরিবারের খবর নিতে আসা স্থানীয় ইউপি সদস্য সারাওয়ার জামান জানান, তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন কিভাবে পরিবারটিকে সরকারি ভাবে সহায়তা নিয়ে দেয়া যায়। তিনি আব্দুর রশিদের স্ত্রী সুলতানা বেগমকে একটি বিধবা ভাতার কার্ড করে দিবেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানান, পরিবারটিকে সরকারি সহায়তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তাদের হাতে সহায়তার চেক তুলে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৩ জানুয়ারি ট্রাক নিয়ে সৈয়দপুর থেকে ফেরার পথে দিনাজপুর চিরিরবন্দরের ভুষিরবন্দর নামক স্থানে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমার আঘাতে চালক ও হেলপার আব্দুর রশিদ ঝলসে যায়। আহত অবস্থায় তাদেরকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত মঙ্গলবার ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে আব্দুর রশিদ মারা যায়।
এমএএস/আরআই