কুষ্টিয়ায় ৪০০ কোটি টাকার পশু বিক্রির সম্ভাবনা
মৌসুমী ব্যবসায়ীদের পদচারণায় জমে উঠেছে কুষ্টিয়ার গ্রামগঞ্জের পশুর হাটগুলো। এবার জেলার পশুর হাটগুলোতে ৪০০ কোটি টাকার পশু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাটগুলোতে কুষ্টিয়ার গরুর আলাদা কদর থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যাপারীরা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাট বাজারগুলো চষে বেড়াচ্ছেন। কে কত বেশি দিয়ে মোটাতাজা পশু কিনবেন সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন মৌসুমী ব্যাপারীরা। ভাল দামে গরু বিক্রি করতে পারায় বেজায় খুশি এলাকার গো-খামারি এবং কৃষকেরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোরবানি ঈদে গরু ছাগলের চাহিদার বড় একটি অংশ মেটায় কুষ্টিয়ার পশু। এবার জেলার ৬টি উপজেলায় ১৭ হাজার ৮১০টি খামার রয়েছে। এর মধ্যে গরু প্রায় ৯০ হাজার, ছাগল ৫০ হাজার এবং ভেড়া ৩ হাজার। সবচেয়ে বেশি খামার এবং পশু রয়েছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সদর উপজেলায় সরকারি মতে, ৪৪০০টি খামারে গরুর পরিমাণ ২৫ হাজার।
তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলায় খামারি এবং কোরবানির পশুর সংখ্যা অনেকগুণ বেশি। সদর উপজেলা, কুমারখালী, খোকসা ও দৌলতপুরে সবচেয়ে বেশি কোরবানির পশু রয়েছে। অন্য উপজেলাগুলোর পরিমাণ একেবারেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিশালাকার গরু পালনের বিষয়টি সকলের জানা রয়েছে।
কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় পশুর হাট আলামপুরের বালিয়াপাড়া হাটে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৮ বিঘা জমির ওপর বসা পশুর হাটে তিল পরিমাণ জায়গা নেই। চরিদিকে শুধু গরু আর গরু। গরু নিয়ে আসা নছিমন-করিমন ও মিনি ট্রাকের কয়েক কিলোমিটার লাইন পড়ে গেছে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহসড়কে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মৌসুমী ব্যাপারীদের ভিড়ে জমজমাট পশুর হাট। দেখে শুনে মোটাতাজা গরু কিনতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। দাম কোনো ব্যাপার নয়, সবচেয়ে ভাল গরুগুলো ক্রয় করতে মহাব্যস্ত ব্যাপারীরা।
হাটের ইজারাদার রবিউল ইসলাম জানান, প্রতি হাটে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার গরু ছাগল আমদানি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা এসেছেন গরু ছাগল কিনতে। কেনাবেচাও বেশ ভাল। গড়ে প্রতি হাটে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ওই ইজারাদার।
তবে হাটে আসা ব্যাপারীদের অভিযোগ, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ইজারাদাররা বাড়তি টাকা আদায় করছেন। কয়েক দিন আগেও গরু প্রতি দুই থেকে তিনশ` টাকা নেয়া হলেও গত শনিবারের হাট থেকে গরু প্রতি নেয়া হচ্ছে ৫ থেকে ৭শ` টাকা। হাটেও রয়েছে নানা ভোগান্তি।
বেপারী শাজাহান আলী জানান, আমাদের জিম্মি করে হাটের ইজারাদাররা ঈদ উপলক্ষে গরু প্রতি দ্বিগুণ টাকার খাজনা আদায় করছেন। প্রতিবাদ করলেই নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। হাটে রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। হাঁটু সমান কাদার মধ্যে হাট বসানো হয়েছে। নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
শুধু আলামপুর হাটই নয়, জেলার উজানগ্রাম হাট, মধুপুর পশু হাট, কমলাপুর হাট, পেড়াদাহ পশুর হাট, বাঁশগ্রাম হাট ও মিরপুর হাটও জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতি হাটেই দুই থেকে তিন হাজার গরু ছাগল বিক্রি হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ ও সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকায় এ বছর ভাল দাম পাওয়ায় উজ্জীবিত কুষ্টিয়ার প্রায় দুই হাজার খামারি। আগামী আরো কয়েক দিন বাজারে দেশীয় গরু বিক্রি বাড়লে গত তিন বছরের লোকসান পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে জানান খামারিরা।
তবে গো-খামারি ও কৃষকদের এই হাসি শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা এ নিয়ে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার গরু প্রবেশের অপেক্ষায় থাকায় খামারিদের মাঝে এক অজানা আতঙ্ক রয়েছে।
জেলার সবচেয়ে বড় খামারি `কাজী ফার্ম` এর মালিক কাজী শওকত জানান, এবার তার খামারে ১৮০টির মতো পশু রয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০টি ঢাকার হেমায়েতপুর জালালাবাদে বিক্রির জন্য নেয়া হয়েছে। বাকিগুলো ঈদের আগেই ঢাকায় নেয়া হবে আর কিছু পশু আগামী বছরের জন্য থাকবে। এর মধ্যে ১৪টি সাদা মহিষ এবং ২০টির মতো ছোট ভুটানি গরু রয়েছে।
তিনি আরো জানান, পুরোদমে কোরবানির পশু কেনা শুরু হয়েছে। ভাল দামে কৃষক এবং খামারিরা পশু বিক্রি করছে। তবে আমাদের কাছে খবর আছে যে, ভারতীয় সীমান্তে (বর্ডারে) কয়েক লাখ গরু, মহিষ রাখা হয়েছে। বর্ডার খুলে দিলেই এবারো কোরবানির পশুর বাজারে ধস নামবে। দেশের কৃষক এবং গো-খামারিদের বাঁচাতে সরকার বর্ডার কড়কাড়ি নজর রাখার জোর দাবি জানান ওই খামারি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশাদুল হক জানান, জেলার চাহিদা মিটিয়ে এ বছর কুষ্টিয়া থেকে প্রায় ৬০ হাজার গরু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় জেলায় যাবে। গড়ে প্রতিটি গরু ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হবে। এসব গরু বিক্রি থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা আয় হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, আমরা বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়েছি কোথাও এখন পর্যন্ত গরু মোটাকরণের জন্য ট্যাবলেট সেবনের অভিযোগ পাইনি। এলাকাবাসীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণাও লিফলেট বিলি করা হয়েছে। প্রকৃত কৃষক ও খামারীরা এই ধরনের কোনো কাজে যুক্ত নন বরং এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কোরবানির আগ মুহূর্তে এ ধরনের কাজ করে থাকে। তবে তাদের ব্যাপারেও আমরা সজাগ রয়েছি।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এসএস/আরআইপি