স্বর্ণ চোরাচালানে ব্যবহৃত হচ্ছে টেকনাফ সীমান্ত
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর পাশাপাশি সম্প্রতি স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে ধরা পড়েছে ৬টি চালান।
এর আগের বছরেও ধরা পড়ে আধা ডজন স্বর্ণ চালান। মিয়ানমার থেকে আনা এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তারা।
একটি সূত্র বলছে, স্থল সীমান্ত দিয়ে আনা কিছু চালান আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশ চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নির্ধারিত স্থানে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাচ্ছে জলপথে ট্রলার মারফত যাওয়া চালানগুলো।
এসব কথার কিছু অংশ স্বীকার করেছেন টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ ও টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালান আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ আনার সময় বিজিবি সদস্যরা কিছু স্বর্ণ জব্দ করলেও বেশির ভাগ সমুদ্রপথে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে।
বিজিবি অধিনায়ক আরো জানান, ভারতে স্বর্ণের চাহিদা বেশি। তাই চক্রের সদস্যরা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের স্বর্ণ এনে কুমিল্লা দিয়ে ভারতে পাচার করছে। টেকনাফের চিহ্নিত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা গেলে স্বর্ণ চোরাচালানের মূল হোতাদের সনাক্ত করা যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিজিবি সূত্র জানায়, ২৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে টেকনাফ বিওপির নায়েব সুবেদার গুরুপদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টহল দল টেকনাফ পৌর এলাকার পুরাতন ট্রানজিট ঘাটে মিয়ানমার থেকে আসা যাত্রীবাহি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে ১১৪ ভরি ওজনের ৮টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। যার বাজার মূল্য আনুমানিক পৌনে ৪৮ লাখ টাকা। এ সময় সংশ্লিষ্টি কাউকে আটক করতে পারেনি বিজিবি জোয়ানরা।
অপরদিকে, গত ২২ ও ২৩ জুন টেকনাফে পৃথক অভিযান চালিয়ে বিজিবির সদস্যরা ১ কেজি ৭০০ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এই স্বর্ণের বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ লাখ টাকা।
এ সময় স্বর্ণসহ হাতেনাতে আটক করা হয় তিনজনকে। তারা হলেন- মিয়ানমারের নাগরিক মো. আরাফাত ও মো. রফিক এবং টেকনাফের পুরান পলানপাড়ার মো. ওসমান। মিয়ানমার থেকে স্বর্ণের চালানটি টেকনাফ এনে চট্টগ্রাম রওনা হওয়ার সময় তারা ধরা পড়েন।
আরাফাত ও রফিক ওই সময় বিজিবির জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন মিয়ানমারের সঙ্গে টেকনাফের স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ছে। মিয়ানমারের মংডু থেকে স্বর্ণ কিনে নৌকায় (নাফ নদী অতিক্রম করে) টেকনাফ আনা হচ্ছে। এরপর টেকনাফ থেকে স্বর্ণের চালান যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে যাচ্ছে ভারতে।
এ দুটি ছাড়াও চলতি বছরের ৫ মে, ২৫ এপ্রিল ও ৫ মার্চ অভিযান চালিয়ে বিজিবি সদস্যরা তিনটি স্বর্ণের চালান আটক করেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আটক করা হয় আরো ছয়টি চালান। বিজিবির উদ্ধার করা স্বর্ণের মোট পরিমাণ ১৮ কেজি ২৪৫ গ্রাম (৯৪টি বার)। এসব অভিযানে আটক করা হয় ১৪ জনকে।
বিজিবি জানায়, গত ২৫ এপ্রিল নাফ নদী দিয়ে টেকনাফ এবং টেকনাফ থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রামে পাচারের সময় বিজিবির সদস্যরা ১ কেজি ৪২৫ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বারসহ টেকনাফের মোহাম্মদ ইদ্রিসকে আটক করেন। এরপর তাকে টেকনাফ থানা-পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
ওই সময় মোহাম্মদ ইদ্রিস পুলিশকে জানান, এর আগেও তিনি টেকনাফ থেকে একাধিকবার স্বর্ণের চালান চট্টগ্রামে নিয়ে গেছেন। চট্টগ্রামে স্বর্ণসহ তিনি আরেকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবার স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।
বিজিবি ও পুলিশ সূত্র জানায়, মিয়ানমার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও ভারতভিত্তিক একাধিক সিন্ডিকেট স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত। টেকনাফের শাহ পরীরদ্বীপ, সাবরাং, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাট, নাইট্যংপাড়া, টেকনাফ স্থলবন্দর, জাদিমোরা, আলীখালী ও চৌধুরীপাড়া দিয়ে স্বর্ণের চালান আসে। তবে বেশির ভাগ চালান সমুদ্রপথে পাচার হয় বলে ধরা সম্ভব হয় না।
টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) কবির আহমদ জানান, সমুদ্রপথে স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে এ খবর পুলিশের কাছে আছে। কিন্তু সমুদ্রে নেমে স্বর্ণ কিংবা ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধ করার মতো আধুনিক জলযান ও জনবল পুলিশের নেই। তবে স্থলপথে স্বর্ণ চোরাচালান ধরতে পুলিশ তৎপর আছে।
পুলিশ জানায়, ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে নেওয়ার পথে পুলিশ একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বারসহ সাইফুল ইসলাম ও কায়সার হামিদকে আটক করেছিল। দুজনের বাড়ি টেকনাফে।
টেকনাফ শুল্ক বিভাগের সুপার নু চ প্রু মারমা বলেন, মিয়ানমারের স্বর্ণের গুণগত মান ভালো বলে চোরাচালানিরা সেদিকে ঝুঁকছে। বিজিবি ও পুলিশ কর্তৃক জব্দ স্বর্ণগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
এসএস/এমএস