ত্রাণ নয়, বাঁধ চাই
আমাগো ত্রাণের দরকার নাই, বাঁচার জন্য বাঁধ করে দেন। আমরা কাজ করে খেতে চাই, বাঁধ তৈরি করে দিলে জমি-জমা সব ফেরত পাবো, আমরা কাজ করে খাবো। তিস্তার পাড়ের বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে এমন আকুতি করেন।
এদিকে, টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের জিঞ্জির খানের ছেলে ফজল শেখ (৭৫) বলেন, ‘বাপ-দাদা যা সম্পদ চিল সবই তিস্তা গিলি খাচঝে বাধ দিলে সব আবার ফিরো পামু। আমাগোরে বাঁচাইতে চাইলে নদীর মইদ্দে (মধ্যে) বাদের (বাঁধের) ব্যবস্থা কইরা দ্যান। আমাগোরে বাচাঁন। আমরা আর সরকারের নিকট ত্যারান (ত্রাণ চাই না)। বাঁচবার নাইগা নদীর মইদ্দে বাদ দিয়া দ্যান।’
তিস্তার পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আর ত্রাণ চায় না, বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত সময়ের মধ্যে তিস্তা নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা। গত ২৪ দিনের টানা বন্যার কবলে তিস্তার বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। সরকারি হিসেবে এক হাজার ৮৬৩ পরিবার বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রতিটি পরিবারের জন্য সরকারিভাবে ৪ দফায় ৭০ কেজি করে চাল, শুকনো খাবার প্যাকেট ও নগদ এক হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। দীর্ঘ ২৪ দিন থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে।
গত মঙ্গলবার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিস্তার হেলিপ্যাড মাঠে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য উপজেলা প্রশাসন ও ত্রাণ মন্ত্রাণালয়ের উদ্যোগে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ এক হাজার করে টাকা বিতরণ করেন।
বন্যায় নিঃস্ব পরিবারের অতি দ্রুত তালিকা তৈরি করে প্রতিটি পরিবারের জন্য দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ছয় হাজার করে টাকা প্রদানের জন্য নীলফামারী জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান দেন।
এসময় মন্ত্রী বলেন, বর্ষার পর তিস্তা নদী খনন করে নদীর দুই পাশে বাঁধ তৈরি করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। শেখ হাসিনার সরকার নদীতে বিশেষ গুরুত্ব নিযে খনন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিস্তা নদীতে দ্রুত সময়ের মধ্যে পলি অপসারণের কাজ শুরু করা হবে।
তিস্তার ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে দুই হাজার পরিবার বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তিস্তা নদীর ভরাট হওয়ায় ফলে গত ২৪ দিনে তিস্তার মূল অংশের বাইরে চরখড়িবাড়ী হয়ে নতুন একটি চ্যানেল তৈরি হয়েছে। টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ী, মধ্য খড়িবাড়ী, পুর্ব খড়িবাড়ী, একতার বাজার, দীঘির পাড়, টাবুর চরসহ ১০টি গ্রামের দুই হাজার ২৪০টি পরিবার বসবাস করলেও ইতিমধ্যে এক হাজার ৬০০ পবিবারের বসতভিটা, আবাদি জমি, বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, পুল কালভার্ট বিলীন হয়েছে।
ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা ও ফরেস্টের চরের ৩৪৫টি পরিবার নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের কিসামত ছাতনাই গ্রামের ৩৫টি পরিবার ও খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ২৫টি পরিবারের বসতভিটা তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, তিস্তার বাঁধসহ উঁচু স্থানে এক হাজার ৮৬৩টি পরিবার বসতভিটা ভেঙে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতসহ সহযোগিতার জন্য সাতটি তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
তথ্য কেন্দ্রে সূত্রে জানা যায়, তিস্তার সিলট্রাপে ৫১৬টি পরিবার, তিস্তার ক্যাঞ্জার ড্যাম (কলম্বিয়া বাধে) ১৪৭টি পরিবার, তেলির বাজার ১২০টি, চেয়ারম্যান বাড়ি সংলগ্ন বাঁধে ৮৪টি, যৌথ বাঁধে ১৭৭টি, সানিয়াজান বাঁধে ২১৭টি, ফ্লাড ফিউজ সংলগ্ন বাঁধে ১৮৭টি পরিবার, খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের দোহলপাড়া বাঁধে ৫০টি পরিবার, কালীগঞ্জ যৌথ বাঁধে ৪০টি পরিবার, ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের পূর্ব ছাতুনামা ৩৪৫টি পরিববার আশ্রয় নিয়েছে।
তিস্তা নদীর নতুন করে চ্যানেল তৈরি হওয়ার ফলে চরখড়িবাড়ী হয়ে নতুন নদীটি পথ পরিবর্তন করায় নীলফামারীর ডিমলা ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নসহ চার হাজার পরিবার ও তিস্তার ফ্লাড ফিউজ চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে।
সরেজমিনে, শুক্রবার তিস্তার বন্যায় আশ্রয় নেয়ার পরিবারগুলো মধ্যে কলিম শেখ (৪৫), আনোয়ারা বেগম (৪৮) , জয়ফুল বেওয়া (৫৫), আবুল কাশেম (৪৫), মকদুম আলীসহ (৮০), বন্যা ও ভাঙনের কারণে নদীগর্ভে পরিবারগুলোর অনেকে বলেন, আমরা সরকারের নিকট ত্রাণ চাই না বাঁচার জন্য তিস্তা নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চাই।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন, খগাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন, ঝুনাগাছ চাপানী ইউপি চেয়ারম্যার আমিনুর রহমান ও পূর্বছাতনাই ইউপি
চেয়ারম্যান প্রভাষক আব্দুল লতিফ খান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। ত্রান বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আর ত্রাণ চায় না। তারা সরকারের কাছে ত্রাণের পরিবর্তে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চায় বলে জানায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাষ মন্ত্রণালয়ের ৩৬০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ও শুকনো খাবারের ২৫০০ প্যাকেজ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণের জন্য কোনো ঘাটতি নেই।
জাহেদুল ইসলাম/এআরএ/এমএস