শাবির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ড. ছদরুদ্দিন আহমদ আর নেই
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেট শাখার সভাপতি বিশিস্ট পদার্থ বিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকাস্থ ল্যাবএইড হসপিটালে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী একাধারে শিক্ষাবিদ, পদার্থ বিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক, গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দক্ষ প্রশাসক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক। বর্ণাঢ্য পেশাজীবনে দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্যের দায়িত্ব পালনসহ আরো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়ী গ্রামের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। বইটিকর পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ১৯৪১ সালে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় তদানীন্তন সমগ্র আসাম প্রদেশে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি পান।
পরে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএসসিতে প্রথম বিভাগে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও ১৯৫৫ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছরই রাজশাহী কলেজের শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারে রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে গবেষণাকাজে জড়িত হন। ১৯৫৮ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন।
১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি বিষয়ে গবেষণা ছাড়াও ‘হিউম্যান ইনসুলিন’ আবিষ্কার তার মৌলিক আবিষ্কারগুলো অন্যতম। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নালে তার ৪০টিরও অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। পালন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা।
প্রফেসর ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী একজন দক্ষ প্রশাসকও। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রধান, শহীদ হাবিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির সদস্য, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের প্রশাসক, সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্যসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অ্যাসোসিয়েশনের কাউন্সিল সদস্য, অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৯ সালে থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালিন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে নিজস্ব জায়গায় ও ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে তার দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনামধন্য শিক্ষকদের সমাবেশ ঘটিয়ে একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেন।
ফলে শুরু থেকেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রফেসর ছদরুদ্দিন চৌধুরী এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ডিন অব স্টাডিজ (একাডেমিক ভাইস চ্যান্সেলর) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে যখন স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে সবকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ হয়ে যায়, তখন প্রফেসর ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর নিজস্ব জায়গায় ক্যাম্পাসসহ সবশর্ত পূরণ করে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।
২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
২০০৬ সাল থেকে সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেট শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাপা, সিলেট শাখা সিলেট বিভাগের পরিবেশ রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রাখছে।
সুদীর্ঘ ৫৪ বছর শিক্ষকতা জীবনে তিনি চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটির ফেলো ও ১৯৯৪-৯৬ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতি, ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অব ক্রিস্টালোগ্রাফির সদস্য ছিলেন।
প্রফেসর ছদরুদ্দিন চৌধুরী যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট ইন কম্পিউটিং মেথডস, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে সপ্তম ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ক্রিস্টালোগ্রাফি, ইটালিতে ন্যাটো অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট ইন ক্রিস্টালোগ্রাফি, হল্যান্ডের আমস্টারডামে দশম আন্তর্জাতিক ক্রিস্টালোগ্রাফি কংগ্রেস, যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক -এ ন্যাটো অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট ইন ডাইরেক্ট মেথডস্, কানাডার অটোয়াতে ১২তম আন্তর্জাতিক ক্রিস্টালোগ্রাফি কংগ্রেস, ভারতের দিলিতে কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সভা, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজের বার্ষিক সাধারণ সভা, যুক্তরাজ্যে কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের ১৫তম সভায় সভাপতি হিসেবে, ১৭তম আন্তর্জাতিক ক্রিস্টালোগ্রাফি কংগ্রেস, তুরস্ক, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও ভারতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ও সেমিনারে অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এছাড়াও বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সিরিয়া, সৌদি আরব, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
তার লেখা বিএসসি (অনার্স) শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান বইটি বাংলা একাডেমি ১৯৮১ সালে প্রকাশ করে। এছাড়া উৎস প্রকাশনী থেকে ২০১০ সালে আত্মকথা নামে আরও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন কন্যাসন্তানের জনক। তার বড় মেয়ে নাসেহা চৌধুরী, ছোট মেয়ে নাইমা চৌধুরী ঢাকায় বসবাস করছেন। মেজো মেয়ে প্রফেসর ড. নাজিয়া চৌধুরী বর্তমানে শাবিপ্রবির লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর। নাসেহা চৌধুরীর স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমদ।
ছামির মাহমুদ/এমএএস/আরআইপি