বশেমুরবিপ্রবি ভিসি
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াতে পারবে না
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন সাবেক উপাচার্য (ভিসি)। পদত্যাগের দুই মাস ১০ দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। এক মাসেরও বেশি সময় হলো তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ছাত্ররাজনীতি, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আশিক জামান অভি।
জাগো নিউজ: দুই মাস ১০ দিন বশেমুরবিপ্রবি অভিভাবকহীন ছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় চ্যালেঞ্জ কী মনে করছেন?
হোসেন উদ্দিন শেখর: চ্যালেঞ্জ যদি বলি বিশ্ববিদ্যালয়টি এক যুগেরও বেশি সময়ে আগে চালু হয়েছে। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়নি। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষক ও প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব। সেই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও পুরোনো অচলায়তন ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুনভাবে সাজানোই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাগো নিউজ: বিগত দিনে বিতর্কিত প্রশাসনের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়েছে, যাদের প্রত্যেকের নেতৃত্বে নিয়োগ-বাণিজ্য, দলীয় পরিচয়ভিত্তিক নিয়োগ এবং স্বেচ্ছাচারিতার মতো অনিয়মের দাপট ছিল। সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং দলীয় পরিচয় বাদে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে একটি দলীয় আস্তানায় পরিণত হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত দিনের সেই অনিয়ম ও দলীয়করণ দূর করতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি-না?
হোসেন উদ্দিন শেখর: বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অনিয়ম আছে। এক একটা করে দূর করতে হবে। শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম আছে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম আছে। কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম আছে। তাদের আপগ্রেডেশনে অনিয়ম আছে। এখানে বিভিন্ন সময় যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনে, সেখানে অনিয়ম আছে। তো অনিয়মের ছড়াছড়ি আছে এখানে। এই অনিয়মগুলো একদিনে দূর করা তো সম্ভব না। যেহেতু এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই অনিয়ম চলছে, এগুলো দূর করতে গেলে আমাদের সময় দিতে হবে।
আরও বিষয় হচ্ছে এটি একটা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। অর্থাৎ গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইউনিভার্সিটির ফ্লেভার হচ্ছে ইউনিভার্সাল অ্যাক্টিং থাকতে হবে। বিভিন্ন জায়গার লোক আসতে হবে। যেমন ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের সব জায়গা থেকে লোক আসে। এটা শুধু যে ঢাকার ছেলেরা পড়ে তা না। সব জেলার লোক আছে। তবে এখানের বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক প্রায় ৯০ শতাংশ গোপালগঞ্জ ও তার আশপাশের জেলার। এসব কিছু ঠিক করতে হলে আমাদের একটু সময় লাগবে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থ সমস্যা। ফলে আমরা হল করতে পারছি না। তো এটিও একটি বড় সমস্যা।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াতে পারবে না। এটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকরাও এই অঞ্চলের, এই অঞ্চলের নেতাদের প্রভাবে তারাও প্রভাবিত হয়েছেন। যে কারণে কোনো ভিসি ঠিক করে কাজ করে যেতে পারেনি। আমি কোনো ভিসির দোষ দেবো না। কাউকে দোষ দেওয়াও ঠিক হবে না।
জাগো নিউজ: শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব কি-না? হলের ডাইনিংয়ে খাবারের মানোন্নয়নের বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
হোসেন উদ্দিন শেখর: আমাদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থ নেই। যে কারণে আমরা হল করতে পারছি না। সব সমস্যার মূলে রয়েছে অর্থ। আমি যোগদানের পরই হলের বিভিন্ন রুমে, গণরুমে শিক্ষার্থীদের সার্বিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে সবকটি হল পরিদর্শন করেছি। গণরুম তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছি। রিডিং রুমের এসি, ওয়াইফাই, হল পরিষ্কার, ডাইনিংয়ের অবস্থা ও খাবারের মান উন্নত করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনার কাছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা কী?
হোসেন উদ্দিন শেখর: এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে মারাত্মক দিক হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও ব্যবহার হয়। যেটা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট না প্রশাসনিক কাজ, সেই প্রশাসনিক কাজেও শিক্ষার্থীরা নাক গলায়। তারা সেখানে আইন তৈরি করে দেখায়। তারা এসব নিয়ে আলোচনা করে। এছাড়া এখানে কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠন আছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে জনমত সৃষ্টি করায় তাদের পক্ষে বা বিপক্ষে। এসব কিছু বাদ দিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চালানো যায় তাহলেই সম্ভব। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক সম্ভাবনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ইনভেস্টমেন্ট আছে। অনেক বড় কিছু করা সম্ভব। তারা যদি শিক্ষক নিয়োগ, কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে কীভাবে সম্ভব? শিক্ষার্থীদের এসব বন্ধ করা উচিত। শিক্ষার্থীদের মতামতে যদি নিয়োগ দিতে হয় তাহলে সেই শিক্ষার্থীই চালাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন বলতে তো আর কিছু থাকবে না।
জাগো নিউজ: ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে প্রশাসন কী ভাবছে?
হোসেন উদ্দিন শেখর: ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। নতুন বাংলাদেশে ছাত্রদের নিয়ে একটা সম্ভাবনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে পড়াশোনার জায়গা, এখন সেখানে শিক্ষার্থীরাও যদি ব্যবহার হয়, কারও পক্ষে ব্যবহার হয় তাহলে তো আর সেই সম্ভাবনা পূরণ হচ্ছে না। তাই এই রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার বাবা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আসামি হয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। সেই বঙ্গবন্ধুর নামের বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে গড়ে তুলতে চান ও কেমন দেখতে চান?
হোসেন উদ্দিন শেখর: আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই। একটা উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই। আমি এবং উপ- উপাচার্য দুজনেই বাইরে থেকে এসেছি। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। একমাস হলো আমরা যোগদান করেছি। এরমধ্যে আমরা অনেক পরিবর্তন এনেছি। আরও পরিবর্তন আনতে চাই। এজন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের প্রশাসনের সহযোগিতা চাই। একক প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব নয়। আমরা যদি মনে করি তাহলে সেটি ভুল হবে।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পর অনেক কর্মকর্তা নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি-না?
হোসেন উদ্দিন শেখর: কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে এবং তিনি যদি সেই কাজে সম্পৃক্ত থাকেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া দেশে তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে। তারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।
আশিক জামান অভি/এসআর/জিকেএস