সভাপতি হয়ে অপরাধের শীর্ষে ওঠেন জাবি ছাত্রলীগের সোহেল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের শিক্ষার্থী আকতারুজ্জামান সোহেল ছিলেন সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে তেমন পরিচিতি না থাকলেও সংগঠনটির সভাপতি হওয়ার পর থেকে নানা অপরাধের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যায় সোহেলের। সোহেলের অপরাধনামায় যোগ হয়- টর্চার সেল, নিয়োগে হস্তক্ষেপ, চাঁদাবাজি, শিক্ষকদের অপমান, অপরাধীদের আশ্রয়দাতা ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। শিক্ষার্থীদের কেউ হলে একটি সিট নিয়ে না থাকতে পারলেও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি থাকতেন দুটি কক্ষে। মাওলানা ভাসানী হলের ৩২২নং কক্ষে তিনি থাকতেন আর ৩২০নং কক্ষ ছিল অনুসারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য।
টর্চার সেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে বহিরাগত ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন সময় চলতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। চলতো মাদক কারবারি ও মাদকসেবীদের আড্ডা। এটি ছিল অঘোষিত টর্চার সেল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুবর নেতৃত্বে চলতো টর্চার সেলের কার্যক্রম। গত বছর জাহিদ হাসান ইমন নামে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতাকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রহারের পর তার শরীরে মদ ঢেলে তাকে মাদকাসক্ত সাজানোর চেষ্টা করা হয়। পরে ইমনের করা সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি উঠে আসে।
শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে হস্তক্ষেপ
রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাদিয়া আফরিনও একটি পদে প্রার্থী ছিলেন। পদে যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও সাদিয়া আফরিনের জোর তদবিরের জন্য তিন পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও সিন্ডিকেট একটি পদে নিয়োগ স্থগিত রাখে। সাদিয়া আফরিনকে নিয়োগ না দেওয়ায় সাবেক উপাচার্য মো.নূরুল আলমকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনের নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রশাসনিক ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড চলমান ছিল। পরে তা স্থগিত করেন উপাচার্য। এই নেত্রীর বিরুদ্ধে পরীক্ষায় নকল করে বহিষ্কার হওয়া, বিভাগের প্রশ্ন ফাঁসের সিন্ডিকেটে জড়িত থাকা ও অবৈধভাবে হলে থাকার অভিযোগ ছিল।
কর্মচারী নিয়োগে হস্তক্ষেপ
ক্যাম্পাসে ইমাম নিয়োগেও ছিল আক্তারুজ্জামান সোহেলের হস্তক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কামালউদ্দিন হল ও সালাম-বরকত হল সংলগ্ন মসজিদের ইমাম নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনে মসজিদের ইমাম নিয়োগ বোর্ডের পূর্বে উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) কক্ষে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও কামালউদ্দিন হলের একাধিক নেতাকর্মী প্রবেশ করে নিয়োগ প্রভাবিত করার অভিযোগ করেন সাক্ষাৎকার প্রত্যাশীরা। মোট ৪৫ জন চাকরি প্রার্থীর মধ্যে ১ জন ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ হোসেনের আপন ছোট ভাই। আর তাকেই নিয়োগ দিতে চাপ প্রয়োগের আশঙ্কা করেছিলেন অন্য প্রার্থীরা। এছাড়াও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য একাধিকবার তার নেতৃত্বে ভিসিকে চাপ দেওয়া হয়।
চাঁদাবাজি
২৫ মার্চ ২০২৩ গত ঈদুল ফিতরের আগে ভাড়া বেশি চাওয়ায় আলহামারা পরিবহনের নবীনগর বাস কাউন্টারে সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় ইংরেজি বিভাগের সজীব মন্ডল নামের এক শিক্ষার্থীর। এর জেরে সজীবের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে (ডেইরি গেট) আলহামারা পরিবহনের বাস আটক করেন। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে মারধরের অভিযোগ তুলে শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বাস কোম্পানির কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে বাস ছেড়ে দেন। ওই বাস আটকের সময় ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তিনি বিষয়টির সমাধান দেননি।
মূলত ওই ঘটনায় ১ লাখ টাকা চাওয়া হয়, না হলে বাসে আগুন দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। পরে ৩৫ হাজার টাকায় সমাধান হয়। টাকা দিয়ে সমাধানে আসার বিষয়ে সভাপতি সোহলের নির্দেশনা ছিল বলেই জানিয়েছেন ছাত্রলীগেরই কয়েকজন নেতা-কর্মী।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল গেইটে বহুবার লেগুনা আটকিয়ে আক্তারুজ্জামান সোহেলের নির্দেশে চাঁদা নিয়েছেন তার অনুসারীরা। প্রতি লেগুনা থেকে দিন প্রতি ২৫ টাকা নেওয়া হতো। দুই মাস ধরে চাঁদা না দেওয়ায় লেগুনা প্রতি দিন ১০০ টাকা করে প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা দাবি করেন ছাত্রলীগের নেতারা। এ ঘটনায় আটক করেন ২৪টি লেগুনা। পরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় ৪ দিন পর লেগুনাগুলো ছাড়ে ছাত্রলীগ।
তখন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, সাজ্জাদের হাতে মিন্টু গাজী ও ফজা মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দেন। লেগুনা থেকে প্রাপ্ত চাঁদার টাকা ভাগাভাগিতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির পক্ষে দেনদরবার করেন এক নম্বর সহসভাপতি সাজ্জাদুল ইসলাম সাজ্জাদ এবং সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে দেনদরবার করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক কার্যকরী সদস্য এসএম দিদারুল আলম দ্বীপ। এছাড়া চাঁদার একটি অংশ (২০ হাজার টাকা) মীর মশাররফ হোসেন হলে অবস্থানকারী ছাত্রলীগ নেতাদের দেন।
শিক্ষকদের অপমান
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে নবনির্মিত ৬টি হল ও একটি গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দুই জন শিক্ষককে তাদের আসন থেকে উঠিয়ে সেখানে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক লিটন। অনুষ্ঠান শুরুর ২৪ মিনিট পর নেতা-কর্মীসহ অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হয়ে সামনের দিকের আসনে জায়গা না পেয়ে ক্ষেপে যান সম্পাদক লিটন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী স্লোগান দিতে শুরু করেন এবং অনুষ্ঠান চলাকালে অডিটরিয়ামে তালা দেওয়ার হুমকি দেন। এর কিছুক্ষণ পর অডিটোরিয়ামে ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল উপস্থিত হলে তৃতীয় সারিতে দুইজন শিক্ষককে তাদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন সাবেক প্রক্টর ফিরোজ-উল-হাসান। শিক্ষকরা গিয়ে বসেন ৬ষ্ঠ এবং সপ্তম সারিতে।
ধর্ষকের আশ্রয়দাতা
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ঘটে যায় এক বিভৎষ ধর্ষণকাণ্ড। যার মূল হোতা মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও আকতারুজ্জামন সোহেলের অনুসারী। মোস্তাফিজকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার জন্য ওই হলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেন সোহেল এবং তার নির্দেশেই মোস্তাফিজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে আশ্রয় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলের চাপে ছাত্রলীগ সভাপতির নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেন মোস্তাফিজ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা
গত ১৫ জুলাই রাতে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগ। সন্ধ্যা এবং মধ্যরাতে কয়েক দফায় শিক্ষার্থীদের ওপর ইট-পাটকেল, পেট্রল বোমা, চাপাতি, রামদাসহ নানা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হমলা করেন তারা। মধ্যরাতের ঘটনায় কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গুলি ছুঁড়তেছেও দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এই হামলায় বাহির থেকে সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনা এবং সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান সোহেল। পরে ওই দিন রাতে আড়াইটা নাগাদ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় ক্যাম্পাস ছাড়েন সোহেল। এরপর থেকে তাকে আর ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।
সোহেলর বিষয়ে ‘গণঅভ্যুত্থানের চেতনা রক্ষা আন্দোলন’র মুখপাত্র ও মার্কেটিং বিভগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইমরান শাহরিয়ার বলেন, মানুষের কছে ক্যাম্পাসের দুর্নামের ৮০ ভাগই হয়েছে ছাত্রলীগের কারণে। চাঁদাবাজি, জমিদখল, মাদক, ধর্ষণ এমন কোনো বাজে কাজ নাই এরা করেনি। আর তাদের লিডার ছিল কুলাঙ্গার সোহেল, যে কিনা ১৫ জুলাই রাতেও শিক্ষার্থীদের উপর সন্ত্রাসী হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওই রাতে আমরা সন্ত্রাসীদের হলছাড়া করতে সক্ষম হয়েছি। তবে এদের নামে মামলা হলেও এখনো এদের গ্রেফতার করা হয়নি। অতি দ্রুত এদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামছুল আলম বলেন, সে (সোহেল) মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েও ক্যাম্পাসের সব কলকাঠি নেড়েছে, নানা ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে গেছে। মানুষের জমি দখল, ব্যবসায় হস্তক্ষেপ, নিজেদের স্বার্থে অনেকগুলো নিয়োগকে বিতর্কিত করাসহ সর্বশেষ ক্যাম্পাসে ১৪ এবং ১৫ তারিখ শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক দফায় যে হামলা এরা করেছে এসবের বিচার অতি দ্রুতই হতে হবে।
সৈকত ইসলাম/এফএ/এএসএম