চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নকল করে মুচলেকা দেওয়া ছাত্রকে শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত সুপারিশ
একটি নয়, দুটি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করেছেন তিনি। হাতেনাতে পাকড়াও হয়েছেন বিভাগের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের হাতে। কিন্তু সেই শিক্ষার্থীকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে করা হয়েছে চূড়ান্ত সুপারিশ। নকলের মতো মারাত্মক অভিযোগ থাকলেও তাকে শিক্ষক নিয়োগে বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের দ্বিমতকে গ্রাহ্য করা হয়নি। ঘটনাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের। অভিযুক্ত প্রার্থীর নাম ছত্রেশ্বর বণিক অমর। তিনি বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, চতুর্থ বর্ষের ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজি টু (৪০৪) এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি (৪০৬) টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করেন অভিযুক্ত প্রার্থী ছত্রেশ্বর। তার নকলের বিষয়টি বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, উক্ত প্রার্থীর ক্ষেত্রে বিভাগের দুইটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
সূত্র বলছে, অভিযোগের পরও বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপস্থিতিতে ভাইভা বোর্ডে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে সর্বোচ্চ সুপারিশ করা হয়। ভাইভা বোর্ডে আরও উপস্থিত ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অঞ্জন কুমার চৌধুরী, ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দানেশ মিয়া, মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রুমানা আক্তার।
বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, প্ল্যানিং কমিটির উভয় সভাতে বিভাগের চেয়ারম্যানকে নোট অব ডিসেন্ট দিতে বাধা দেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্ল্যানিং কমিটির সদস্য ড. অরুনাভ বৈরাগী। মূলত বিতর্কিত ওই প্রার্থী তার পছন্দের হওয়ায় তিনি তার নিয়োগের জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র অনুসারে, ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য সিন্ডিকেটে এই প্রার্থীর প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে।
অভিযুক্ত প্রার্থীর পরীক্ষায় অসদুপায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ছত্রেশ্বর বণিক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী থাকাকালে আমার কোর্সের টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে। আমি তার নকলসহ খাতা এবং তার মুচলেকাসহ সমুদয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং করোনাকালে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কার্যক্রম বন্ধ থাকায় উইপোকা বইসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলে। এতে ওই জরুরি খাতাটাও (নকল এবং মুচলেকা) নষ্ট হয়ে যায়।
এর আগে ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি ও ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। একটি পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৩৭ জন এবং ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন ১৩ প্রার্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, অসদুপায় অবলম্বন করা প্রার্থী যদি বিভাগের শিক্ষক হন তিনি শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দেবেন? মূলত কিছু শিক্ষক তাদের বলয়কে শক্তিশালী করার জন্য জোর করে এমন প্রার্থীকে নিয়োগের চেষ্টা করছেন। এই প্রার্থী শিক্ষক হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনৈতিকতার উদাহরণ তৈরি হবে যা আমাদের জন্য লজ্জার।
এ বিষয়ে প্ল্যানিং কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্ল্যানিং কমিটির একজন সদস্যই নকলের অভিযোগ আনেন। আমরা প্ল্যানিং কমিটি থেকে যাচাই-বাছাই করে যে মন্তব্য পাঠিয়েছি সেখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করে দিই। এরপরও আসলে তাকে কেন সর্বোচ্চ সুপারিশ করা হয়েছে তা বোর্ড জানে। এমন না সেখানে যোগ্য প্রার্থী ছিল না। অনেক পটেনশিয়াল প্রার্থী ছিল, যাদের ভালো রেজাল্ট এবং রিসার্চ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে ড. অরুনাভ বৈরাগী জাগো নিউজকে বলেন, ওই প্রার্থী মেধাবী। এটা সত্য তার ওপর আমার আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি যোগ্য কেউ বিভাগের শিক্ষক হোক। এর বাইরে কিছুই না।
বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে নোট অব ডিসেন্ট দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একেবারেই সত্য নয়। প্ল্যানিং কমিটির প্রথম সভায় আমি শুধু বলেছি তথ্য-প্রমাণ ছাড়া নকলের মন্তব্য দেওয়া উচিত নয়। তবে প্ল্যানিং কমিটির সাতজনের চারজন মন্তব্য দেওয়ার পক্ষে থাকায় তার নামের পাশে নকলে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম না।
ভাইভা বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ভাইভা বোর্ডে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে তার বিষয়ে সিন্ডিকেটের আগে কোনো আলোচনা আমি করতে পারবো না। এ বিষয়ে মন্তব্য করাও সমীচীন নয়।
এ বিষয়ে জানতে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রুমানা আক্তারের মোবাইলফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্র অবস্থায় কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলে এবং সেটা যদি নিয়োগ বোর্ড জানে তাহলে বোর্ডের বিবেচনা করার কথা। নিয়োগ বোর্ডকে অবশ্যই বিষয়টি দেখতে হবে।
এ বিষয়ে ছত্রেশ্বর বণিক অমরের বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে ফোন দিলে তিনি কল কেটে দেন।
আহমেদ জুনাইদ/এমআরআর/জেআইএম