‘দেশে আত্মহত্যার কারণ নিয়ে তেমন গবেষণা নেই’
দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। এ তালিকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষরাও রয়েছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দরকার।
আত্মহত্যার কারণ ও তা থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর উপায় নিয়ে কথা বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম। তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সিলেট শাখার আর্ডেন্টিয়ার, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সহ-সভাপতি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সুনাক (সচেতন নাগরিক কমিটি) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের শাবিপ্রবি প্রতিনিধি নাঈম আহমদ শুভ-
জাগো নিউজ: সম্প্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে রুয়েটে দুই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে শাবিপ্রবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এভাবে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার কারণ কী?
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: প্রথমত, আমাদের দেশে আত্মহত্যার কারণ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে আপনি যেটা বলছেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা বাড়ছে সেটা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়; সারাদেশেই বেড়েছে। এরসঙ্গে করোনা মহামারির একটা যোগসূত্র আছে। কয়েকটি গবেষণার আলোকে আমি যদি নির্দিষ্টভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আত্মহত্যার বিষয়টি বলি তাহলে কারণ হিসেবে র্যাগিং, ইভটিজিং, মর্মপীড়া, অত্যধিক মানসিক চাপ, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা ইত্যাদি দেখতে পাই। এগুলো খুব স্বাভাবিক কারণ। এর পাশাপাশি ছাত্রজীবনে সম্পর্কজনিত ব্যর্থতা, পড়াশোনায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে ব্যর্থতা ও পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আরও পড়ুন: ৩ দিনের ব্যবধানে গলায় ফাঁস নিলেন আরও এক রুয়েট ছাত্র
জাগো নিউজ: আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ করেছেন। এ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার উপায় কী হতে পারে?
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: এটা কঠিন প্রশ্ন। আসলে আত্মহত্যার বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীরা কিছু প্রাথমিক লক্ষণের কথা বলেছেন। কারও হয়তো পরিবারে মানসিক রোগের হিস্ট্রি আছে কিংবা বাইপোলার ডিসঅর্ডার কিংবা পরিবারের দরিদ্রতা। এসব কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার বিষয়ে বলতে গেলে আগে দেখতে হবে কারা আত্মহত্যা করছে। দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কারণে যেমন আত্মহত্যা করছে, অন্যদিকে তাৎক্ষণিক কারণে সুস্থ মানুষও আত্মহত্যা করছে। মনোবিজ্ঞানীরা প্রাথমিক যে লক্ষণের কথা বলেন তারমধ্যে কেউ যখন আত্মহত্যা করতে চায় সে প্রথমে নিজেকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তার মুডসুয়িং হয়, ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় সে বারবার বিদায়ের কথা বলে। তার নরমাল রুটিনে পরিবর্তন হয়। পরিবার-বন্ধুবান্ধবসহ সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ভার্সিটিতে ঠিকমতো যায় না, তার ঘুম আসে না। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে এরকম কিছু প্রাথমিক লক্ষণের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আমরা সচেতন করতে পারি। আসলে কে আত্মহত্যা করবে সেটা আগে থেকে বলা যায় না। যদি তার সমবয়সী বন্ধুরা তার পাশের কোনো বন্ধুদের মধ্যে এ ধরনের লক্ষণ দেখতে পায় তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেটা জানাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেল রয়েছে যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের পরিধি আরও বাড়ানো যেতে পারে। আত্মহত্যার প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে এটা ঠিক যে ঢালাওভাবে আলোচনা করা ঠিক নয়। এতে অনেকে ভ্রান্ত ধারণা নিতে পারে। এখানে শিক্ষকদের একটা ভূমিকা থাকবে। কাউন্সেলিংয়ে যারা থাকবেন তাদের একটা ভূমিকা থাকবে। তবে বন্ধু-বান্ধবদের ভূমিকা অনেক বেশি বলে আমি মনে করি।
আরও পড়ুন: নিজের পিস্তলের গুলিতে প্রাণ গেলো কনস্টেবল রনির
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার মতো দুঃসাহসিক কাজকে অনেকটা স্বাভাবিক মনে করেন। আত্মহত্যার পরিণতি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: বিষয়টা যে স্বাভাবিক মনে করে সেরকম নয়। আসলে আত্মহত্যা দুইভাবে হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ অনেক বেশি পেইন থেকে বা তার ইমোশনাল পেইন এত বেড়ে যায় যে সে এটি নিতে পারে না। ফলে আত্মহত্যা করে। আরেকটি হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে কোনো হতাশা থেকে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্মহত্যা কেন বাড়ছে এগুলোর কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সেল যেমন ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা দপ্তর এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলসহ বিভিন্ন সেলের সদস্যরা এ বিষয়ে খোঁজ নিতে পারেন। এটা প্রতিরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সেটা চিন্তা করতে পারেন। এছাড়া বিভাগের শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। আমার কোন শিক্ষার্থী ড্রপ আউট করছে, ক্লাসে আসছে না কেন...আমরা যদি একটু সচেতন হই, একটু ভালোভাবে কাউন্সেলিং করি, একটু তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারি তাহলে অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি।
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইলে ট্রেনের নিচে প্রেমিক যুগলের ঝাঁপ
জাগো নিউজ: এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: আমি সমাজকর্মের শিক্ষক। পাশাপাশি কাউন্সেলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমার তরফ থেকে আমি আমার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সবসময় বলি যে তোমাদের জীবন যখন থমকে যাবে আমার দরজা তোমাদের জন্য সবসময় খোলা। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে যে শিক্ষকের কাছে কমফোর্ট ফিল করো তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারো। করোনার পর নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের। প্রতিটি বিভাগের শিক্ষক একেকজন কাউন্সেলরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে, শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো ধৈর্য সহকারে শুনলে, যেসব শিক্ষার্থীদের ক্লাস পারফরম্যান্স খারাপ তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বললে আশা করা যায় শিক্ষার্থীরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে পারে। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে অনেক শিক্ষার্থীর বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোতে সে পরবর্তীতে উঠে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: তেলাপোকা মারার ওষুধ খেয়ে চবি ছাত্রীর মৃত্যু
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে অদূর ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হতে পারে?
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: আত্মহত্যার ফলাফল অবশ্যই নেতিবাচক। তবে আমি বলতে চাই যে পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। আসলে আমরা অনেকটা অস্থির সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা শান্তিতে থাকার জন্য, রিল্যাক্স থাকার জন্য নিজেরা কিছু পথ বের করতে পারে। এখন পাশ্চাত্যে মেডিটেশন, ইয়োগা ও রিল্যাক্সেশন প্রক্রিয়া খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মদের এগুলোর দিকে উৎসাহিত করতে পারি। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল ও স্বেচ্ছাসেবী কাজে জড়িত থাকতে পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে যাতে একজন শিক্ষার্থী তার মনের বিষয়গুলো শেয়ার করার সুযোগ পায়। এতে তার ভেতরের চাপা ক্ষোভ প্রশমিত হবে এবং আত্মহত্যার মতো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে তার জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে।
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসআর/এমএস