‘অতিথি নয়, পরিযায়ী পাখি বলাই যৌক্তিক’
শীতকাল এবং পরিযায়ী বা অতিথি পাখি যেন একসূত্রে গাঁথা। দেশের হাওর ও উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও সমতলের বেশকিছু এলাকায় এসেছে পরিযায়ী পাখি। আগামী কয়েক মাস দেখা মিলবে তাদের। অনেকের কাছে পাখিগুলো অতিথি পাখি হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলাই যৌক্তিক বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক খ্যাতিমান গবেষক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মূলত বর্ষার শেষে এবং শীতের আগে থেকেই এসব পাখি আসা শুরু করে। দেশের হাওর এলাকা, কক্সবাজারের সোনাদিয়ার মতো বেশকিছু দ্বীপ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর, চরকুকরী মুকরী কিংবা দুবলার চরেও দেখা মেলে তাদের। মার্চ মাসের শেষ নাগাদ পাখিগুলো ফিরে যায় তাদের গ্রীষ্মকালীন নিবাসে।
নিরিবিলি পরিবেশ থাকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবছর শীতকালে ছুটে আসে পরিযায়ী পাখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক, রেজিস্ট্রার ভবন সংলগ্ন লেক, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার ও সুইমিংপুল সংলগ্ন লেকে বিচরণ করে তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখি আসে। এদের মধ্যে ৬৯টি বিদেশি প্রজাতির পাখিও দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশ পাখিই সরালি বা হাঁস প্রজাতির। যারা দিনের কোনো একসময় পানিতে থাকতে পছন্দ করে এবং পানির মধ্যে থেকেই বিভিন্ন গুল্ম উদ্ভিদ ও পোকামাকড় খুঁজে খায়। গত কয়েক বছরে লেকগুলোতে বালিহাঁস, সরালি, জলপিপি, লেঞ্জা, বড় সরালি, ছোট সরালি, পাতারি, চখাচখি, জিরিয়াহাঁস, নর্থগিরিয়া, খঞ্জনা, চীনা হাঁস, গারগেনি, রাইনেক, টাইগা, কমনচিল, পান্তামুখী, পাতি হাঁস, পানিমুরগি, কটনচিল, পাতিবাটান, পান্তামুখী, নীলশিরসহ নামে-বেনামে প্রায় ২০৫ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে।
অতিথি না পরিযায়ী?
যার আগমনে কোনো তিথি নেই তিনিই অতিথি। সহজ কথায় যার আসা যাওয়ার কোনো নিদিষ্ট দিনক্ষণ নেই এবং আসা-যাওয়া ঐচ্ছিক তারাই অতিথি। ভিনদেশি এ পাখিগুলোর বেলায় কিন্তু তারা শীতের হাত থেকে বাঁচা, খাদ্য সংগ্রহ এবং প্রজননসহ বেশ কিছুর তাগিদে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে আসে। টিকে থাকায় লড়াইয়ে এটা তাদের একটা অবলম্বনও বটে। এমনটা মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এম মনিরুল এইচ খান।
তিনি জাগো নিউকে বলেন, যে পাখিগুলো বাংলাদেশে আসে তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলাই যৌক্তিক। পরিযায়ী পাখি মানে যারা পরিভ্রমণ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় আবার ফিরে আসে। তাদের অতিথি বললে এমন একটি ভুল বার্তা যায় যে, তারা বেড়াতে আসে। তারা চাইলে আসতে পারে আবার নাও আসতে পারে। কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয়।
অধ্যাপক এম মনিরুল খান বলেন, পরিযায়ী পাখির দুইটি নিবাস-একটি শীতকালীন অপরটি গ্রীষ্মকালীন। এই দুইটির কোনো একটিতে সমস্যা হলে তাদের জীবন বিপন্ন হবে।
পরিযায়ী পাখি এবং প্রাণী নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন আছে, সেখানে বলা আছে, যে দেশগুলোতে তারা গ্রীষ্মকাল এবং শীতকাল কাটায় অথবা যে দেশগুলোর ওপর দিয়ে তারা চলাফেরা করে সেগুলোও তাদের দেশ। বাংলাদেশও এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী। সে হিসেবে আমাদের দেশে যে পাখিগুলো আসে তারা কিন্তু অতিথি নয়, যোগ করেন এই অধ্যাপক।
জাহাঙ্গীরনগরে পরিযায়ীরা আসে কোথা থেকে
অনেকেই পরিযায়ী পাখির নাম শুনলেই সাইবেরিয়া, রাশিয়া বা ইউরোপকে তাদের আবাসস্থল ভেবে বসেন। কিন্তু অধ্যাপক এম মনিরুল জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পাখিগুলো আসে, তাদের সিংহভাগেই আসে হিমালয় পর্বতমালা থেকে। সেখানে শীতের তীব্রতা বেশি থাকে। তবে ধারণা করা হয়, কিছু পাখি মধ্য এশিয়া, সাইবেরিয়া, উত্তর এশিয়া এবং কিছু ইউরোপ থেকে আসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন আছে পরিযায়ীরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের কিছু জলাশয়ে, কিছু গাছপালা এবং ঝোপাঝাড়ে বসে। চলতি বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাম্পাসের ট্রান্সপোর্ট এলাকা ঘেঁষা লেকে বেশকিছু পরিযায়ী পাখিকে বিচরণ করতে দেখা যায়। তাদের কলকাকলিতে ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে ওঠে। তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ট্রান্সপোর্ট এলাকার লেকটিতে দেখা মিলছে না পরিযায়ীদের।
পাখি বিশেষজ্ঞ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মনে করেন, মূলত উপদ্রবের কারণেই পাখিগুলো এই লেকটি ত্যাগ করেছে এবং তারা তুলনামূলক নিরিবিলি পরিবেশে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের লেকে অবস্থান নিয়েছে।
একই রকম আশঙ্কার বার্তা দিয়েছেন অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খানও। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের অবস্থা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, শুধু জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে নয়, পুরো দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমতির দিকে। অনেক জায়গায় তা আশঙ্কাজনক। জলাশয়ে আসা পাখিদের বৈচিত্র্য দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। আগে বেশ কয়েক প্রকার পরিযায়ী হাঁস এখানে আসতো, এখন সেগুলো সেভাবে আর আসছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পরিযায়ী পাখি ও প্রজাপতি
পরিযায়ী পাখি এবং প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করে আসছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একদিকে যেমন চলছে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ, অপরদিকে চলছে গাছপালা কেটে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সর্বশেষ প্রজাপতি মেলায় পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, উন্নয়ন হোক, উন্নয়নের সঙ্গে বিরোধ নেই। তবে তার সঙ্গে ক্যাম্পাসের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হোক। একটা সময় ক্যাম্পাসে ১২০ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া গেলেও এখন সেটি কমে ৫২ প্রজাতিতে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত একটা সময় আসবে যখন আমরা ক্যাম্পাসে আর প্রজাপতি খুঁজে পাব না।
একইভাবে যেকোনো অবকাঠামো উন্নয়ন বন্যপ্রাণির জন্য প্রাকৃতিক আবাসস্থলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খান।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের কাছেই লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সুউচ্চ একটি ভবনসহ ক্যাম্পাসে ১০তলা বিশিষ্ট ছয়টি আবাসিক হল পাখির ‘ফ্লাইং জোনে’ বাধা সৃষ্টি করবে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের তাগিদ জানিয়েছেন তারা।
এমআরআর/এএসএম