একবার হলেও আত্মহত্যার চিন্তা করেন ২৮% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
দেশের ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ২৮ শতাংশের মাথায় জীবনের কোনো না কোনো সময় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরতদের প্রায় ৪৪ শতাংশ চরম দুশ্চিতায় ভুগছেন।
সম্প্রতি গবেষণা নিবন্ধটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসে ‘মোটিভেশনস অ্যান্ড ব্যারিয়ারস ফর ক্লিনিক্যাল মেন্টাল হেলথ-সিকিং ইন বাংলাদেশি ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ সায়েন্স সেন্টারের পোস্ট-ডক্টরাল রির্সাচ ফেলো মুনজিরিন এস সিফাত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইমা তাসনিম, পেনসিলভেনিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নুসরাত হক ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের কয়েকজন গবেষক।
২০২০ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৫০ শিক্ষার্থীর দেওয়া তথ্য চূড়ান্ত করে ডেটাসেট তৈরি করা হয়।
তথ্যদাতাদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬৩ শতাংশ। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণকারী ৫ শতাংশের নিচে। অংশগ্রহণকারীদের ৫৭ শতাংশ পুরুষ এবং প্রায় ৪২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। যাদের ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ স্নাতক পর্যায়ের। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ নিজেদের প্রেমের সম্পর্কবহির্ভূত (সিঙ্গেল) বলে দাবি করেছেন। এছাড়া তথ্য দেওয়াদের ৭৩ শতাংশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান বলে জরিপে উঠে আসে।
গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ক্লিনিক্যাল সহায়তাকে ইতিবাচক বলে দেখেন। যাদের ৭ শতাংশ ক্লিনিক্যাল সহায়তা নিয়েছেন। যেখানে শিক্ষার্থীদের ১০ শতাংশ মানসিক সমস্যা সমাধানে যান্ত্রিক ও আচরণগত বাধা অনুভব করেছেন। এছাড়া ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কমপক্ষে অপর একজনের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলাপ করেছেন।
গবেষণায় আরও উঠে আসে, ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাপারে সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। ক্লিনিক্যাল সমাধানের বাইরেও শিক্ষার্থীরা মানসিক সমস্যা সমাধানে আত্মপরিচর্যা, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বাদ দেওয়া, লম্বা শ্বাস নেওয়া, গভীর ধ্যান করা প্রভৃতি কাজ চালিয়েছিলেন।
গবেষণায় বলা হয়, পুরুষদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মানসিক স্বাস্থ্যে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এছাড়া বিদ্যমান কুসংস্কারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে ক্লিনিক্যাল সহায়তার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা এখনো খুব একটা আগ্রহী নয় বলে দাবি করা হয় এ গবেষণায়।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের কিংস কলেজ অব লন্ডনের ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি’তে প্রকাশিত অপর এক গবেষণা নিবন্ধে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্রেমঘটিত ব্যাপার, অতি আবেগপ্রবণতা, স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা, পারিবারিক কলহ, শিক্ষাজীবনে অসফলতা, যৌন নির্যাতন ও মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করা হয়।
গবেষকেরা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষণীয় প্রচারণার বিষয়ে তাগিদ দেন। এছাড়া গবেষকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে, শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সমস্যা থাকলে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে সেজন্য খোলামেলা আলোচনার ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ এই সেবাটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়ারও পরামর্শ দেন।
গবেষকদলটির প্রধান মুনজিরিন এস সিফাত জাগো নিউজকে বলেন, খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে শুধু যে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় তাই নয়, বরং এটি মানুষের নিজের মানসিক সমস্যাগুলো কোনোরকম অস্বস্তিবোধ ছাড়াই সহজেই অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের নিশ্চিত করা উচিত যে তাদের একটি কাউন্সিলিং সেন্টার আছে এবং সেখান থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভালো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।
গবেষক মুনজিরিন আরও বলেন, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে রোগী এবং সেবাদানকারীর মধ্যকার ব্যবধানটা অনেক বেশি। মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এর একটি কারণ হতে পারে। মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে এবং নিরাময়ের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তত দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে একজন মানুষ যত বেশি দিন অতিবাহিত করবে, তত বেশি সমস্যাটি বেড়েই যাবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে পারেন।
এমআরআর/জেআইএম